বাংলাদেশে ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক আছে, যেখানের ৪৮টি’র নাম নিজ নিজ অবস্থানগত জেলার নামে।
একমাত্র ব্যতিক্রম সুইডিশ পলিটেকনিক যার অফিশিয়াল নাম বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, যে নাম সারা বাংলাদেশের নামকে রিপ্রেজেন্ট করে। এই ইনস্টিটিউটের কোন শিক্ষার্থীই নিজেদের পলিটেকনিকের ছাত্র পরিচয় দেয় না, বলে সুইডিশের স্টুডেন্ট।
কেন এই পলিটেকনিক বাংলাদেশের নাম রিপ্রেজেন্ট করে বা কেনই বা নামের সাথে সুইডেন দেশের নাম জড়িত?
সে এক ইতিহাস। আমরা অনেকেই এখন পাহাড় পর্বতে যাই। গিয়ে নানান আইটেমের ছবি ভিডিও ব্লগ প্রকাশ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করি খুব দূর্গম পাহাড়ি জঙ্গল আবিষ্কার করেছি। এখনো অনেকেই রাত ৮ টার পর পার্বত্য অঞ্চলে চলাচল করে না।
আসলে ব্যাপারটা তা না। সেই ১৯৫৩ সালে যখন এশিয়ার সর্ব বৃহৎ কর্ণফুলী পেপার মিল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল, একই সাথে কাপ্তাই এর গহীন জঙ্গলে আরো দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় বিদেশী নাগরিকদের হাতে।
একটি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আরেকটি সুইডেন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। তখন কাপ্তাই ছিল আমেরিকা, জার্মানী, ইতালি আর সুইডেনের মানুষদের মিলনমেলা। সংখ্যায় তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চেয়েও বেশি ছিল।
কর্ণফুলী পেপার মিলের প্রধান কাঁচামাল ছিল বাঁশ। এই বাঁশ চিপিং করার জন্য কাপ্তাই বাঁধের কিনারায় একটি চিপিং প্লান্ট বানানো হয়। তখনকার দিনে কাপ্তাই অঞ্চলে সেগুন গাছের আধিক্যের কারণে চিপিং প্লান্টের পাশে একটি পাল্পউড প্রসেসিং কারখানা এবং একটি অত্যাধুনিক উড সিজনিং প্লান্ট স্থাপন করে তারা।
এই উড কিভাবে সিজনিং করে সে টেকনোলজি পাকিস্থানী জনগোষ্ঠীকে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) শেখানোর জন্য তারা সাথে আরো তিনটি টেকনোলজি সহ মোট চারটি উড, ইলেক্ট্রিক্যাল, মেকানিকাল এবং অটোমোবাইল নিয়ে সুইডেন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট নামে একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালু করে।
যেখানে প্রতিটি টেকনোলজির জন্য ১০ জন করে ৪০ জন স্টুডেন্ট ভর্তি করানো হতো। এই ৪০ জনের জন্য ছিল পৃথক ৪০টি রুম, প্রতিটি প্রায় ১৫০ স্কয়ার ফিট করে।
তাদের জন্য সে যুগে যত আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন ছিল, সব কিছুই ছিল। সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ছিলেন সুইডেনের নাগরিক। তারা ক্যাম্পাসে, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাস করতেন। পরে এখানের স্টুডেন্টদের সুইডেন সহ বিভিন্ন দেশে স্কলারশিপ দিয়ে আরো উচ্চতর পড়াশোনার জন্য নিয়ে যাওয়া হতো।
পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় একাত্তর সালে। ৭২-এ এই প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ করে সুইডেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি করা হয় এবং ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়। আরো পরে এই প্রতিষ্ঠানকে ডিপ্লোমার কাতারে ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট করা হয়।
সম্ভবত এই প্রতিষ্ঠানে এখন বছরে দুই শিফটে মিলে দুই হাজারের অধিক শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা প্রকৌশল বিষয়ে পড়ে। নতুন করে কম্পিউটার এবং কনন্সট্রাকশন নামে দুটি টেকনোলজি এ্যাড করা হয়েছে যদিও ভৌত অবকাঠামো সেই ৪০ জনের যা ছিল তাই।
সেই যে সুইডিশদের হাতে বানানো প্রতিষ্ঠানের লেজ রয়ে গেল, তারা এখনো সে স্মৃতি ভুলতে পারে নাই। এর অবশ্য কারণও আছে। সুইডিশরা বিজ্ঞানীর জাত। শিক্ষার জাত। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জাত। সভ্য জগতের অতি আধুনিক জাত। জটিল, কুটিল রাজনীতি বা অসভ্য নাগরিকদের দেশ নয়।
যেই এম্বেসেডর বাংলাদেশে আসে, সেই কোন না কোন একটা সময়ে সুইডিশে এসে ঘুরে যায়। পূর্বপুরুষদের বানানো অবয়বে, কাঠামোয়, নকশায়, স্মৃতিতে হাত বুলায়। নানা ভাবে ইনস্টিটিউট প্রশাসনকে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সুইডেন সরকারকে দিয়েই এই সুইডিশকে আরেকটি বুয়েট বানাতে পারে।
আজকেও ক্যাম্পাসের মায়াভরা পথে হেঁটে গেলেন সুইডিশ এম্বেসেডর। দেখেই মনটা খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠল কারণ আমাকেও কারিগর বানিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এর পরের বিএসসি মিএসসি আলু কচু কিছুই আর সুইডিশের মত আমাকে গড়ে দিতে পারে নাই। যা কিছু, বেসিক সুইডিশ থেকেই। আরেকটা মালের কথা না বললে নয়। হানিফ সংকেত। এখানের ভ্রুণ।
ভালোবাসা লাল দেয়াল।
ছবিগুলো ইনবক্সে পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানের ইনস্ট্রাক্টর এজাবুর।
লেখকঃ ইমরুল শাহেদ