এই দেশে অত্যন্ত ভালো মানের পিএইচডি সম্ভব। অতীতে কিছু হয়েছে। বর্তমানেও কিছু হচ্ছে। কিন্তু খুব ভালো মানের পিএচডির সংখ্যা অত্যন্ত কম। শতকরা হিসেবে হয়ত ১% হবে না।
পিএইচডির নামে যেসব প্রায় অখাদ্য বাজারে আসছে সেগুলোই আমাদের দেশের গবেষণাকে রিপ্রেজেন্ট
করে।
পিএইচডি সম্পর্কে সর্বসাধারণের ধারণা এই অখাদ্যগুলোকে দেখেই গড়ে ওঠে। ষ্ট্যাণ্ডার্ড বিচার করার সময় ও যোগ্যতা বেশীরভাগেরই নেই। কাজেই দেশি পিএইচডি শুনলেই যা ভাবার ভেবে নেয়।
অত্যন্ত দুঃখজনক। পরিশ্রম ও মেধার জোরে দেশে থেকে যারা অসাধারণ সব কাজ করে পিএইচডি অর্জন করেছেন তাদের কৃতিত্ব দেশের বাইরে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা ভালো মানের পিএইচডি করেছেন তাদের থেকে কম নয় বলেই বিবেচনা করি।
আপসোস, এই সমস্ত কৃতি গবেষকেরা ‘দেশি পিএইচডি’, তাই খারাপ, ধরণের একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহজে রেহাই পাবেন না। কত বড় অবিচার!
এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে একদল নীতিহিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কারণে। প্রায় কোন ধরণের সামর্থ্য ও মান সম্পর্কে ধারণা ছাড়াই এরা মুড়ি-মুড়কির মত পিএইচডি ‘উৎপাদন’ করে যাচ্ছে।
শিক্ষকতার সাথে সাথে এই ডিগ্রীটির মর্যাদা তলানিতে ঠেকেছে। দেখার কেই আছে বলে মনে হয় না। যাদের দেখবার কথা তারা অনেকেই অ্যাকাডেমিক নষ্টামিতে সেরা।
পিএইচডি কোর্সে ভর্তির সময় ছাত্রছাত্রীদের কিছু যোগ্যতা দেখা হয়। এর থেকে অনেক বেশি প্রয়োজন সুপারভাইজারের রিসার্চ রেকর্ড যাচাই বাছাই করা। পিএইচডি রিসার্চ ছেলেখেলা নয়। এটাকে যারা ছেলেখেলা বানাচ্ছেন তারা অ্যাকাডেমিক ফ্রড।
মূল দোষটা আমলা, মন্ত্রী, জেনারেল, আইজি সাহেবদের নয়। তাদের নিয়ে মজা করার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিজেদের ঘর সামলানো অনেক বেশি জরুরী।
আজ একটা লেখায় দেখছি- দেশে আজ পর্যন্ত কোন ভালো মানের পিএইচডি ডিগ্রী হয়নি!
“এই দেশে আজ পর্যন্ত কোন ভালো মানের পিএইচডি ডিগ্রী হয়নি। পিরিয়ড! কেউ যদি বলে এখানেও কিছু ভালো পিএইচডি হচ্ছে সে তাহলে ভালো মানের পিএইচডি কাকে বলে তার সংজ্ঞাই জানেনা। আমার জানার বাহিরে একজন দুজন থাকলে সেটাকে ব্যতিক্রম হিসাবে নেওয়া যেতে পারে উদাহরণ হিসাবে না।”
একটু জট লেগে গেল!
১। “এই দেশে আজ পর্যন্ত কোন ভালো মানের পিএইচডি ডিগ্রী হয়নি। পিরিয়ড!”; অনেক বড় স্টেইট্মেন্ট! এত জোর দিয়ে বলতে হলে অনেক জানতে হয়।
২। “কেউ যদি বলে এখানেও কিছু ভালো পিএইচডি হচ্ছে সে তাহলে ভালো মানের পিএইচডি কাকে বলে তার সংজ্ঞাই জানেনা।”; এটাও বড় স্টেইট্মেন্ট। মনে হচ্ছে যারা পিএইচডি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে, তারা অনেকেই পিএইচডির ষ্ট্যাণ্ডার্ড সম্পর্কেই জানে না!
৩। “আমার জানার বাহিরে একজন দুজন থাকলে সেটাকে ব্যতিক্রম হিসাবে নেওয়া যেতে পারে উদাহরণ হিসাবে না।”; প্রথম স্টেইট্মেন্টের সাথে কেমন প্যাঁচ লেগে গেল! না কি আমার স্বল্প বুদ্ধিতে ঠিক ধরছে না?
আমি বেশি জানি না। তবে এটুকু জানি, দেশে পিএইচডি করে আমার বিভাগ থেকেই কেউ কেউ ইউরোপ এবং আমেরিকায় গবেষণার জন্য সম্মানজনক ফেলোশিপ পেয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ইউরোপে পোস্টডক করছে এবং করেছে এমন একাধিক গবেষক আমার চেনা।
দেশ থেকে পিএইচডি করে সাইটেশন সংখ্যায় এবং প্রকাশনার বিচারে, “এই দেশে আজ পর্যন্ত কোন ভালো মানের পিএইচডি ডিগ্রী হয়নি। পিরিয়ড!” ধরণের বক্তব্য দেওয়া অধ্যাপকের থেকে এগিয়ে থাকা তরুণ ছাত্র আমারই আছে। কাউকে বড় বা ছোট করতে নয়, just to make the point clear, কথাটা বলতে হল।
জ্ঞানের অভাবে আমরা যারা ‘ভালো জাতের পিএইচডি’ বুঝতে পারি না, তারাও অনেকে স্বীকার করি দেশে খুব কমই মানসম্মত কাজ হচ্ছে।
কিন্তু ভালো কাজ যারা করছেন (এদের ভেতর অনেকেই অনায়াসে বিদেশে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে পারতেন, পারিবারিক বা অন্য কোন কারণে সুযোগ নিতে পারেন নি), তাদের ছোট করার অধিকার কারো নেই। পিরিয়ড।
কিছু লেখার আগে আরেকটু খোঁজখবর করাটা খারাপ নয়।
দেশি ও বিদেশি পিএইচডি নিয়ে তর্ক বেশ জমে উঠেছেঃ
একটি কাল্পনিক ঘটনার অবতারণা করি। বাংলাদেশের কোন একটি ‘বড়’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হবে। দু’জন প্রার্থী, একজন হার্ভাড থেকে পিএইচডি করা, অপরজন দেশের কোন এক ‘ছোট’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
আপনি কাকে চাকরীর জন্য বেছে নেবেন?
Bayesian statistics নামে এক ধরণের সম্ভাবনার তত্ত্ব আছে। আপনি যদি এই পরিসংখ্যান ব্যবহার করেন তাহলে নির্দ্বিধায় হার্ভাডের পিএইচডি বেছে নেবেন। তবে আপনি যদি Bayesian statistics বোঝেন, তাহলে বিপদ আছে। নির্দ্বিধায় এই পরিসংখ্যান আর ব্যবহার করা যাবে না।
ইনফ্যাক্ট, কোথা থেকে পিএইচডি করেছে, এই তথ্য থেকে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। দুই প্রার্থীকেই আপনার যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে। ব্যক্তির যাচাই বাছাই যেখানে প্রশ্ন, সেখানে প্রতিষ্ঠানের রেপুটেশন অথবা ভৌগোলিক অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ না।
অথচ এই ভুলটি এই দেশে হরদম হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখানে অগ্রগামি।
বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে। এর বাইরে সবই ইতং বিতং।
শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে যে অল্প কিছু মানসম্পন্ন পিএইচডি হয়েছে, হচ্ছে এর স্বীকৃতি দিতে অসুবিধাটা কোথায়, তা ধরতে পারছি না।
যারা দেশে অসম্ভব বলছেন, অথবা বলছেন নেই, তারা অসম্ভব অথবা নেই শব্দের অর্থ বোঝেন?
Conjecture এবং তার refutation সম্পর্কে অনেক লেখালেখি আছে। ‘গবেষক’ হতে গেলে সেগুলো একটু পড়ে দেখা দরকার।
লেখকঃ সালেহ হাসান নাকিব
অধ্যাপক
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়