মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নামে সচিবালয় ও নগর ভবনের মাঝে অবস্থিত উদ্যানটির নামকরণ করা হয়। বেশ কয়েকটি জাতের দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষে শোভিত করে গড়ে তোলা হয়েছিল ওসমানী উদ্যান।

এখানে রাখা আছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলার আসাম যুদ্ধে ব্যবহৃত একটি ঐতিহাসিক কামান। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময়ে দুটি ছোটখাটো লেক, লেকের মধ্যে কৃত্রিমভাবে তৈরি দুটি ছোট বালু দ্বীপ তৈরি করে উদ্যানটিতে প্রাণের ছোঁয়া লাগানো হয়েছিল।

‘গোসসা নিবারণী পার্ক’ তৈরির নামে দীর্ঘ আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে উদ্যানটি। পুরো পার্কটি টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ২০১৮ সালে পার্কটির সংস্কার শুরু হলেও আড়াই বছরের বেশি সময় হলেও এখনো শেষ হয়নি এক বছর মেয়াদি কাজ। কতটুকু কাজ শেষ হয়েছে এ বিষয়ে জানেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও।

কাজ শুরুর অনুষ্ঠানে তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, ‘এই পার্কে যখন মানুষ আসবে, স্বাভাবিকভাবে তাদের ভালো লাগবে, উৎফুল্ল লাগবে। এখানকার যেসব আয়োজন, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই মানুষের গোসসা বা রাগ কমিয়ে দেবে। এই চিন্তা থেকেই এটাকে “গোসসা নিবারণী পার্ক” নাম দেওয়া হয়েছে।’ (সূত্র-বাংলা ট্রিবিউন জানুয়ারি ২৭, ২০১৮)

একটি উদ্যানে যে মিউজিক সিস্টেম, বিজ্ঞাপনের জন্য বড় স্ক্রিনের টেলিভিশন থাকার কথা নয়, তা আমাদের নগর প্রশাসনের কি জানা নেই?

পরিকল্পনায় বলা হয়, পার্কটিতে মিউজিক সিস্টেম, বসার জন্য আলাদা আলাদা জোন, বাচ্চাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা এবং বড় স্ক্রিনে টেলিভিশন দেখার সুবিধা থাকবে। উদ্যানের লেককে আরও দৃষ্টিনন্দন করা হবে। থাকবে প্যাডেল বোট। পার্কের মধ্যেই থাকবে ফুড কোর্ট এবং ভলিবল ও ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে পার্কে বাজবে হারানো দিনের গান।

বিস্তৃত ওয়াকওয়েতে হেঁটে ক্লান্ত পথিকেরা হাতের নাগালে পাবেন বিনা মূল্যে রাস্তার পাশে ব্যবস্থা করা সুপেয় পানি। থাকবে জিম ও ইয়োগা করার ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে থাকবে নগর মিউজিয়ামের বিশাল আয়োজন। অভ্যন্তরীণ ড্রেনেজ সিস্টেম ও বিদ্যুতায়নে পুরো পার্কে থাকবে আলোর ঝলকানি। (সূত্র-ইত্তেফাক ১৪ অক্টোবর, ২০২০)

প্রথমে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হলও পরে তা বাড়িয়ে ৮৬ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু নতুন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়িয়ে পানিনিষ্কাশন, পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন যোগ করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ১০০ কোটি টাকার ওপর। পার্কটির কাজ করছে ‘দি বিল্ডার্স লিমিটেড’। স্থপতি রফিক আজম ইত্তেফাককে বলেন, ‘যে ঠিকাদার কাজটি পেয়েছেন, তাঁদের যোগ্যতা আছে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। বারবার মেয়াদ বাড়িয়েও আমরা কাজ শেষ করতে পারিনি।’

২.

সচিবালয়ের ১৭ দশমিক ৫৭ একর জমির মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে বহু ভবন নির্মাণ করায় এ এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। কয়েক বছর ধরে সামান্য বৃষ্টিতেই সচিবালয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

এ ছাড়া সচিবালয়ের পশ্চিমে (লিংক রোড) পুরো রাস্তা অস্থায়ী পার্কিং জোনে পরিণত হয়েছে। এতে জাতীয় প্রেসক্লাবসহ সচিবালয়ের বাইরের অফিসগুলোতে চলাচলে ও যানজটে চরম দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ। সচিবালয়ের আটটি ভবন ও তিনটি টিনশেডে ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং ১১টি (ছোট-বড়) হোটেল বা ক্যানটিন রয়েছে। একটি করে এটিএম বুথ, সাংবাদিক কক্ষ, ডে-কেয়ার সেন্টার ও ক্লিনিকও আছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী সচিবালয়ের কোনো ভবনেই নেই নিজস্ব গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা।

৩.

একটি উদ্যানে যে মিউজিক সিস্টেম, বিজ্ঞাপনের জন্য বড় স্ক্রিনের টেলিভিশন থাকার কথা নয়, তা আমাদের নগর প্রশাসনের কি জানা নেই? আলোর ঝলকানি যে নৈশকালীন প্রাণী পাখি ও পতঙ্গ প্রজাতির (নাইট লাইফ) জন্য অনুকূল নয়, সেটাও আমাদের নগরনেতা ও নগর পরিকল্পনাকারীদের বিবেচনায় এল না? আমরা কি এতটাই নির্বোধ হয়ে গেলাম?

গোসসা নিবারণের সত্য বা মিথ্যা দিয়ে শুরু করে, ড্রেনেজ সিস্টেম, জাদুঘর, লাইব্রেরিসহ নগর মিউজিয়ামের বিভিন্ন কাজের সত্য-মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এখন দেখা যাচ্ছে, ওসমানী উদ্যানে আসলে তৈরি করা হচ্ছে সচিবালয়ের জন্য বিশাল বহুতল পার্কিং, ড্রেনেজ স্টোরেজ।

নির্বিচারে কাটা হয়েছে বহু গাছ, প্রায় সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করা হয়েছে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের দিককার লেক ও বালুচরটি। ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে ভিন্ন ধরনের বিশালাকৃতির স্থাপনা। টিন দিয়ে ঘিরে কাজ করলেও গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবিতে পাওয়া গেল তারই প্রমাণ।

যানজটপূর্ণ সচিবালয় এলাকায় পার্ক করা যায় সর্বোচ্চ এক হাজার গাড়ি। কিন্তু পাস দেওয়া আছে নয় হাজারের বেশি। গাড়ি পার্কিংয়ের যে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাতে ওসমানী উদ্যান হবে পার্কিংয়ের দখলে। স্যাটেলাইট ইমেজে তারই প্রমাণ মিলেছে। (সূত্র-সমকাল ১৫ নভেম্বর ২০২০)।

ইট-পাথরের জঞ্জালে ভরা নগরীতে মানুষের জন্য বিনোদন বা উন্মুক্ত জায়গায় আড্ডা দেওয়ার স্থান যেখানে খুবই কম, সেখানে পার্কিংয়ের জন্য উদ্যান ধ্বংসের হীন পরিকল্পনা কেন? এই জবাব কি নগর প্রশাসন দেবে?

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।