রসায়নকে সেন্ট্রাল সাইন্স বলা হয় । বিজ্ঞানকে যদি আমরা একটি বিশাল প্রাসাদের সাথে তুলনা করি এবং ঐ প্রাসাদের প্রবেশদ্বার যদি তিনটি হয় তাহলে মূল প্রবেশদ্বারটির নাম রসায়ন । অপরদুটি প্রবেশদ্বারের একটি হলো পদার্থবিদ্যা ও অপরটি হলো জীববিদ্যা ।

তবে মূল প্রবেশদ্বার রসায়ন হওয়ায়; রসায়ন একহাতে পদার্থবিদ্যার সাথে গভীর সম্পর্ক রাখে তেমনি অন্যহাতে যুথবদ্ধ হয় জীববিদ্যার সাথেও । যারা রসায়ন পড়ে তাদেরকে যেমন ফিজিক্যাল বা ভৌত রসায়ন পড়তে হয় তেমনি জৈব রসায়ন বা প্রান রসায়নও পড়তে হয় ।

২০২৪ সালের ড্রাফট রসায়ন সিলেবাস যেখানে রসায়ন নামে আলাদা কোনো বিষয় রাখা হয়নি নবম শ্রেনীর জন্য । বিজ্ঞান নামক বইয়ে রসায়নের চারটি অধ্যায় রাখা হয়েছে যা হলো : পদার্থের অবস্হা, পদার্থের গঠন, পর্যায় সারনি এবং রাসয়নিক বন্ধন ।

বর্তমান কারিকুলামের সাথে আমরা ১৯৯৬ সালের কারিকুলাম তুলনা করতে পারি । ১৯৯৬ সালে নবম ও দশম শ্রেনীর রসায়ন বইটি লিখেছিলেন ড. সরজ কান্তি সিংহ হাজারী যিনি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক । ড. হাজারী একাই বইটি লিখেছিলেন ।

বইটির একডেমিক কন্টেন্ট বেশ ভালো । ১৬টি অধ্যায় । অসাধারন সিলেবাস । বইটিতে চিত্রের সংখ্যা কম । একটু বেশী বর্ননামূলক কিন্তু প্রত্যেকটি অধ্যায়ের কন্টেন্ট এমনভাবে লেখা যে এই বইটি পড়লে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেনীর রসায়ন পড়া ছাত্রদের জন্য সহজ হত ।

১৯৯৬ সালের কারিকুলাম পরিবর্তন করে ২০১৩/১৮ সালে নবম ও দশম শ্রেনীর জন্য রসায়নের জন্য আলাদা বই লেখা হয় । এই বইয়ের লেখক ছিলেন পাঁচজন । প্রথম তিনজন হলেন বিদ্যুৎ কুমার রায়, তাপস কুমার আচায্য, ও মোকাদ্দেছুল ইসলাম । এদের কারোই রসায়নে পিএইচডি নেই ।

ধারনা করা যায় এই তিনজন মূল লেখক । এই তিনজন বাদে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ লেখক হিসাবেও আছেন যদিও তারা রসায়নের শিক্ষক নন । এই বইটিতে ১২টি অধ্যায় আছে । বইটির একডেমিক কন্টেন্ট দুর্বল এবং সংক্ষিপ্ত যদিও লানিং আউটকাম ও প্রজেন্টেশান অনেক ভালো ।

বর্তমান কারিকুলামের সাথে আমরা যদি ১৯৯৬ সালের কারিকুলামে থাকা আধ্যায়গুলো তুলনা করি, তাহলে ১৬টি অধ্যায়ের আটটি নবম শ্রেনীতে এবং অপর আটটি দশম শ্রেনীতে পড়ানো হয়েছিল বলে ধারনা করা যায় । ১৯৯৬ সালের কারিকুলামের থাকা প্রথম আটটি অধ্যায় হলো

১. পদর্থের অবস্হা ও পরিবর্তন,

২. পদার্থের গঠন,

৩. আভোগেড্রোর সূত্র,

৪. সংকেত, যোজনী ও সমীকরন,

৫. পরমানুর গঠন,

৬. রাসয়নিক বন্ধন,

৭.পর্যায় সারনি এবং

৮. রাসয়নিক ত্রিুয়া ।

বর্তমান কারিকুলামে আভোগেড্রোর সূত্র নামক অধ্যায়টি নেই । আভোগেড্রোরর ধারনা রসায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন এং এটি ছাড়া মোল, আনবিক ভর, স্টোইচিওমেট্রি, পরমানু বা অনুর সংখ্যা অথার্ৎ গানিতিক রসায়নের ভিওি অনেক দূর্বল থাকবে ।

বর্তমান বইতে গানিতিক রসায়নের ধারনাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় নি । তাছাড়াও রাসয়নিক ত্রিুয়া অধ্যায়টি বর্তমান সিলেবাসে নেই । রাসয়নিক ত্রিুয়া হলো এমন একটি বিষয় যেটি না থাকলে অসংখ্য প্রোডাক্ট বা পন্যসামগ্রী যেমন: সার, ব্যাটারি, তডিৎ, সিমেন্ট, ও ওষুধ তৈরির মোলিক ধারনা থেকে ছাত্ররা বঞ্চিত হবে ।

সংকেত, যোজনী ও সমীকরন নামে নতুন সিলেবাসে কোন অধ্যায় নেই, খুবই সংক্ষিপ্তভাবে এই বিষয়গুলো নতুন বইতে লেখা হেছে ।

আর একটি সমস্যা হলো ২০২৪ সালের নবম শ্রেনীর নতুন বিজ্ঞান বইয়ে ‘জৈব অনু’ নামক যে অধ্যায়টি যারা লিখেছেন তাদের জৈব ও প্রান রসায়নে নূন্যতম ধারনা নেই । জৈব অনু (organic molecule) মানেই প্রান অনু (Biomolecule) নয় । অথচ লেখকরা জৈব অনুকেই প্রান অনু বলছেন ।

প্রান অনু পড়ানোর আগে জৈব যৌগ পড়ানো প্রয়োজন । জৈব রসায়নের ধারনা ব্যতিত প্রান রসায়ন পড়ানো যায় না । রসায়নে জৈব রসায়ণ (Organic Chemistry) ও প্রান রসায়ন (Biochemistry) এর পার্থক্য খুব পরিস্কার । যারা রসায়ন সম্পর্কে নূন্যতম ব্যাচেলার লেভেলের জ্ঞান থাকবে সে এই পার্থক্য সহজেই বুঝবে ।

বাংলাদেশে থাকা অসংখ্য ছাত্র ইংলিশ মিডিয়ামে ক্যামব্রিজ কারিকুলামের ও-লেভেলে পড়শুনা করে । ও-লেভেলের (নবম ও দশম শ্রেনীর) রসায়ন সিলেবাসে ১২টি অধ্যায় আছে ।

অধ্যায়গুলো হলো ১. পদর্থের অবস্হা, ২. পরমানু, মৌল ও যৌগ, ৩. স্টোইচিওমেট্রি ৪. তড়িৎ রসায়ন ৫. রসায়নিক শক্তি, ৬. রাসয়নিক ত্রিুয়া, ৭. অম্ল, ক্ষার ও লবন, ৮. পর্যায় সারনি, ৯. ধাতু, ১০. পরিবেশ রসায়ন ১১. জৈব রসায়ন, ১২. এক্সপেরিমেনটাল টেকনিক এবং কেমিকেল এনালাইসিস ।

কেমব্রিজের ও এবং এ লেভেলের কারিকুলাম চেয়ে বিশ্বে অন্য ভালো কোনো কারিকুলাম নেই এটি ব্যাপক গবেষণা করে তৈরি করা হয়েছে এবং পৃথিবীর অসংখ্য দেশের ছেলে-মেয়েরা এই কারিকুলামে পড়াশুনা করে । ও-লেভেলের রসায়ন সিলেবাসটির সাথে যদি আমাদের ১৯৯৬ সালের রসায়নের সিলেবাস তুলনা করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে আমাদের আগের রসায়ন বইটির কন্টেন্ট ক্যামব্রিজ কারিকুলামের ও-লেভেলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় ।

এই সিলেবাস পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না । বরং এটিকে আর একটু ভালো প্রেজেন্টেবল করলেই হত ।

অনেকেই বর্তমান কারিকুলামকে ফিনল্যান্ডের কারিকুলামের আদলে তৈরী করা হয়েছে বলে দাবী করেন । ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বসেরা বলা হয় । ফিনল্যান্ডের মাধ্যমিকে দুটি লেভেল আছে: নিন্ম মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চ মাধ্যমিক । নিন্ম মাধ্যমিক হলো সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেনীর জন্য ।

আগ্রহ নিয়ে তাদের সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেনীর রসায়নের সিলেবাস দেখলাম । সপ্তম, অষ্টম ও নবম, প্রতিটি শ্রেনীতে তাদেরকে আলাদাভাবে রসয়ান পড়ানো হয় । যেখানে আমরা আমাদের নতুন সিলেবাসে নবম শ্রেনীর জন্য রসায়নের আলাদা বই রাখিনি । ফিনল্যান্ডের সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেনীর সিলেবাস এক কথায় অসাধারন । সপ্তম শ্রেনীতে রসায়নের জন্য তারা ১২টি অধ্যায় পড়ায় ।

প্রথম অংশটিতে দ্য ওয়াল্ড অব কেমিষ্ট্রি (The world of Chemistry) যেখানে ৬টি অধ্যায় আছে । দ্বিতীয় অংশটিতে পানি ও বায়ু (Water and Air) যেখানে ৬টি অধ্যায় আছে । অষ্টম শ্রেনীতে রসায়নের জন্য তারা ১৫টি অধ্যায় পড়ায় । প্রথম অংশটিতে পরমানু থেকে যৌগ (From Atoms to Compounds) যেখানে ৪টি অধ্যায় আছে ।

দ্বিতীয় অংশটিতে কার্বনের রসায়নের (The Chemistry of Carbon) ৪টি অধ্যায় আছে । এবং তৃতীয় অংশটিতে গৃহস্থালির রসায়নে (Chemistry at Home) ৭টি অধ্যায় আছে । নবম শ্রেনীতে রসায়নের জন্য তারা ১১টি অধ্যায় পড়ায় । অথার্ৎ সবমিলিয়ে ফিনল্যান্ডের সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেনীতে ৩৯টি অধ্যায় পড়ানো হয় যা বিশ্বের যেকোনো দেশের রসায়ন শিক্ষাত্রুমের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ । সত্যি যদি ফিনল্যান্ডের কারিকুলাম অনুসরন করা হতো তাহলে আমাদের বিজ্ঞন শিক্ষা ব্যবস্হায় আমূল পরিবর্তন হতো ।

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা দেখতে পারছি যে আমাদের বর্তমান কারিকুলাম বাস্তবায়ন করলে আমাদের শিক্ষার্থীরা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাশ করা ছাত্র-ছা্ত্রীদের চেয়ে নিঃসন্দেহে কম রসায়ন শিখবে বিশেষ করে গানিতিক রসায়ন, রসায়নিক ত্রিুয়া ও জৈর রসায়ন সঠিক ধারনা থেকে তারা বঞ্চিত হবে ।

আমি আশাকরি আমাদের সরকার বর্তমান বিজ্ঞান শিক্ষাত্রুম বাতিল করবে এবং দেশ ও বিদেশের থাকা রসায়ন শিক্ষক ও গবেষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করবে যারা নতুন কারিকুলামে রসায়নের জন্য আলাদা বই রাখবেন এবং ১৯৯৬ সালের সিলেবাসের আলোকে নতুন সিলেবাস তৈরি করবেন ।

ড. মোহাম্মদ আব্দুল হালিম, পিএইচডি
সহকারী অধ্যাপক, রসায়ন ও প্রান রসায়ন বিভাগ
কেনেসা স্টেট ইউনিভার্সিটি, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ।