“২০০৪ সাল। এসএসসি পরীক্ষায় কেরাণীগঞ্জে প্রথম জিপিএ ৫ পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছিলাম, ততটা বা তার চেয়ে বেশি বোধ হয় কষ্টও পেয়েছিলাম।

পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজন, স্কুলের কতিপয় শিক্ষক ও কমিটির সদস্য, পাড়া প্রতিবেশি, পরিচিত অপরিচিত কাছের ও দূরের প্রায় সবার একই কথা,

“এত ভালো রেজাল্ট করে কলাতিয়ায় পড়ে থাকবি?”তখন জিপিএ ৫ এর অনেক কদর ছিল, ঢাকা শহরের প্রায় সব ভালো কলেজগুলোতেই চান্স পাওয়া যেত।

আমার সাথে আরো যারা জিপিএ ৫ পেয়েছিল, সবাই শহরে ভর্তি হয়ে গেল।

কিন্তু কাউকে বুঝাতে পারলাম না যে, বাকি সবার অবস্থা আর আমার অবস্থা এক না; এত ভালো রেজাল্ট করে যেখানে মিষ্টি খাওয়ানোর পয়সা নেই, সেখানে শহরে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখাই তো বিলাসিতা।

অবশেষে সবাইকে দুঃখ দিয়ে আমি সেই কলাতিয়া ডিগ্রি কলেজেই ভর্তি হলাম। আমার পাশে একজন ব্যক্তি শুধু সাপোর্ট হিসেবে ছিলেন, তিনি আমার জন্মদাত্রী মা।আমার কলেজ জীবন শুরু হল।

গ্রামের কলেজ আর স্থানীয় লোকজনের আনাগোনার ফলে খুব একটা নিয়মের বালাই ছিল না।আমি ছাড়া প্রায় ছাত্রছাত্রীই নিয়মিত কলেজে আসতো না, কলেজ ড্রেসও ঠিকমতো পরতো না।

ফি কমানোর জন্য স্থানীয় লোকজনের ভিড় লেগেই থাকতো। আবার অবশ্য কোনো ফি লাগে নি।প্রাইভেট পড়াও ফ্রি ছিল, তবে খুব একটা যেতাম না।

বরং শিক্ষা উপকরণ, কলেজ ড্রেস, মাসিক ১০০ টাকার বৃত্তি কলেজ থেকেই পেয়েছি। কলেজের অবকাঠামো খুব একটা ভালো ছিল না;

প্র‍্যাকটিক্যাল ক্লাসের সরঞ্জামের অভাব ছিল, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই ছিল না, বৃষ্টির দিনে টিনের চাল দিয়ে কিছু শ্রেণিকক্ষে বৃষ্টির পানি পড়তো।

কলেজে আসা-যাওয়া চার কিলোমিটার পথ, পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিতাম। সাইকেল কেনার সামর্থ্যও ছিল না। নিজের হাত খরচ খুব একটা লাগতো না।

তারপরও আব্বাকে মাঝেমধ্যে সাহায্য করা আর ছোট ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ যোগানোর জন্য টিউশন করতে হতো, কারণ নিজের পড়াশোনা কিংবা অন্য কোনো কাজে বা ঈদ উৎসবে বাড়ি থেকে এক পয়সাও কখনো নেই নি বা নিতে পারি নি।

পড়াশোনার পাশাপাশি গৃহস্থালি প্রায় সব কাজই করতাম। নিজের জামাকাপড় কখনোই মাকে দিয়ে ধোয়াতাম না, নিজেই ধুতাম।নিজেদের টিউবওয়েল ছিল না, অন্যের বাড়ি থেকে খাবার পানি আনতাম। আব্বার সাথে নিয়মিত ফসলের ক্ষেতে কাজ করতাম।

বাড়িতে ফসল মাড়াই ও সংগ্রহ করতাম। মায়ের সাথে ধান সিদ্ধ করা, ধান শুকানো, গম নেয়া, সরিষা নেয়া, ইত্যাদি কাজে সহায়তা করতাম।

তাছাড়া বাড়িতে গরু-ছাগল ছিল, সময় পেলেই চকে-বন্দে ক্ষেতের বাতর/আইল থেকে গরুর ঘাস কাটতাম, চকে ছাগল চড়াতাম, সকাল-বিকাল গরুকে কুড়া-ভূষি খাওয়াতাম।গ্রামে সমবয়সী কেউ ছিল না আড্ডা দেয়ার।

কলেজের সহপাঠীরাই আমার কাছের ছিল। মাঝেমধ্যেই দোলা, রলি কিংবা ইমুদের বাড়ি চলে যেতাম।তখন অবশ্য কাউকে বন্ধু ভাবতাম না, কারণ বন্ধুত্ব আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ছিল।

এদের মধ্যে Mansura Roly ছিল খুবই সিরিয়াস এবং পরিশ্রমী। এসএসসি পাশ করার আগে থেকেই সে নিয়মিত কলেজে যেতো তার বোনের সাথে।আমাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকতো, কিন্তু আমি কাউকে সহযোগী ছাড়া প্রতিযোগী ভাবি নি।মাঝেমধ্যে স্যারদের বাসায়ও যেতাম।

স্যাররা খুবই আন্তরিক ছিলেন এবং আমাকে খুব ভালোবাসতেন। বিশেষ করে কলেজের অধ্যক্ষ Md Liaquat Ali স্যার আমাকে খুবই আদর করতেন ও উৎসাহ দিতেন।

সময় গড়িয়ে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। সহপাঠীরা পরীক্ষা নিয়ে ভীত হলেও আমি আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করি।

পরীক্ষার দিনও ভোরে গরুর ঘাস কেটে গোয়াল থেকে গরু বের করে কুড়া-ভূষি খাওয়ায়ে নিজে গোসল করে খেয়েদেয়ে টিউশনের উদ্দশ্যে রওনা দেই, সেখানে দুইটা ব্যাচ পড়িয়ে কলাতিয়া থেকে রামেরকান্দা ইস্পাহানি কলেজে সকাল ১০টায় পরীক্ষা দিতে যাই।

আবার পরীক্ষা শেষ করে আরেকটা টিউশনে যাই। এভাবেই চলছিল কলেজ জীবন।অবশেষে আসলো ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬। বর্ষাকাল। দুপুরের দিকে খালের পানিতে কাপড়চোপড় ধুচ্ছিলাম।বিকালে ফলাফল দিবে, তাই পরিষ্কার পোশাক পরে কলেজে যাবো।

হঠাৎ করে ফারুক স্যার সাইকেলে করে এসে আমাকে খবর দিল আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি।আমি জিজ্ঞেস করলাম, রলির কী খবর। না, রলি জিপিএ ৫ পায় নি।

মনটা খারাপ হল, কারণ সে অনেক ভালো ছাত্রী এবং এটার জন্য সে আমার চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করেছে।ফারুক স্যার চলে গেলে আমি তড়িঘড়ি করে কলেজে পৌঁছে যাই।

আমার মা আমার সাথে আসতে চাইলে আমি মানা করি, কারণ তাঁকে এত ছোট জায়গায় হাইলাইট করতে চাই নি, আরও অনেক উঁচু জায়গায় তাঁর স্থান, কিন্তু তিনি আসলেনই।

কলেজে গিয়ে জানতে পারলাম, পুরো কেরাণীগঞ্জে আমিই একমাত্র জিপিএ ৫ পেয়েছি।”
—–
লিখেছেন প্রিয় শিক্ষক শাহ আলম স্যার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাউন্টিং ডিপার্টমেন্ট এ এসিসটেন্ট প্রফেসর হিসাবে কর্মরত