স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের মালিক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসাইন সম্পর্কে যত জানছি ততোই অবাক হচ্ছি।
তার মতো ভাল মনের মানুষ আছে বলেই আজ আমরা সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারছি, আমাদের সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানার ছেলে মোশাররফ। তিন তিনবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন তিনি। যমুনার কড়াল থাবায় নিয়ে গেছে তার নিজের পরিবারের ও প্রতিবেশীর বাড়িঘর। আপন চাচাকে দেখেছেন চরম দারিদ্রে দিনাতিপাত করতে।
তখন থেকেই সব সময়ই তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে নদী ভাঙ্গনের শিকার হতদরিদ্র এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করার,,,,।
BUET থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর নিজের সামর্থ্য মত এই গরিব মানুষগুলোকে অর্থ সাহায্য দিতে লাগলেন।
কিন্তু সে পদ্ধতি কাজ করল না। তার মতে গরীবের হাতে অর্থ কোন উপকারে আসে না, তাদের প্রয়োজন কাজের; যাতে নিয়মিত অর্থের জোগান হয়।
সেই ভাবনা থেকেই গড়ে তুলেন স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টস। বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের ৫৫ হাজারের বেশি শ্রমিকের অধিকাংশই সিরাজগঞ্জ জেলার। অত্র এলাকার দারিদ্র বিমোচনে বিরাট অবদান আছে তার।
কারখানার শ্রমিকদের সাথে এক অন্যরকম সুসম্পর্ক ছিল তার। তার মতে শ্রমিকরা সুস্থ থাকলে তবেই তারা ভাল কাজ করতে পারবে। “আমি শ্রমিকদের কখনোই শ্রমিক বা কর্মী বলি না, সহকর্মী বলি। নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসি ওদের।”
কেনো শ্রমিকের স্বজন মারা গেলে তার দাফন-কাফনের খরচ কারখানা বহন করত। গরিব শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাও ছিল। সব কারখানাতেই মেডিক্যাল সেন্টার আছে। সেখানে ডাক্তার, নার্স, ওষুধ সবই বিনা মূল্যে দেওয়া হয়।
গর্ভবতী শ্রমিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও আছে। আছে চাইল্ড কেয়ার সেন্টার। শ্রমিকদের জন্য সব কারখানায় সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুল্যান্স মোতায়েন রাখা আছে। আর মাসের বেতন, বোনাস প্রথম সপ্তাহেই বেতন দিয়ে দেয়া হত।
তার যে জিনিসটি সব চেয়ে অবাক করার মত সেটা হচ্ছে তার মনোবল। এতো কিছুর পরও ভেঙ্গে পড়েননি তিনি, হারাননি শ্রমিকদের(তার ভাষায় সহকর্মী) উপর আস্থা।
প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে অনেকেই তাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন কিন্তু তিনি কোন সাহায্য চান না, তিনি সরকারের কাছে শুধু ঋণ চান। তার বিশ্বাস তিনি তার শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে সঠিক সময়ে সেই ঋণ শোধ করে দিতে পারবেন।
এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল অথচ কেন তিনি সরকারের কাছে কোন বিশেষ সুবিধা বা সুদবিহীন ঋণ সুবিধা চাচ্ছেন না এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের দেশ একটি গরিব দেশ। আমরা কার অর্থ নিব।
সে অর্থ দিয়ে হয়ত সরকার গরিব দুঃখীর দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে। আমার এখন একটাই লক্ষ্য, কিভাবে এই কর্মহীন মানুষগুলোকে কর্মে ফেরানো যায়।”
মোশাররফ হোসাইনের অফিস কক্ষটি অত্যন্ত সাধারন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের সাথে একটি কক্ষ শেয়ার করেন তিনি, নেই কোন নিজস্ব আলাদা রুমের ব্যবস্থা।
আর তার যে গার্মেন্টস পুড়ে গেল তার প্রতি ফ্লোরের আয়তন ৬৫ হাজার স্কয়ার ফুট। তার মানে একসাথে এক ফ্লোরে দু’টি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা যায়!
একটা ফ্যাক্টরীর হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নামাজের জামাত হত ওনাদের কোনাবাড়ী ফ্যাক্টরিতে। একসাথে আঠারো হাজার লোক জামাতে জোহর, আসর, মাগরিব এবং এশার নামাজ পড়ত।
ওদের সেলাই ও অন্যান্য মেশিন এমনভাবে সেটিং করা আছে যাতে মেশিনের সাথে দাঁড়ালেই কাতারবদ্ধ হয়ে যায়। ছেলেরা ছেলেদের লাইনে ও পর্দার ভেতর মেয়েরা মেয়েদের লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। আযান দেয়ার সাথে সাথে সবাই ওযুখানায় চলে যায়।
নামাজ পরার জন্য বিশ মিনিট সময় দেয়া হয়, নামাজ শেষে মাইকে কোরান হাদিসের বাণী প্রচার করা হয়। জোহর নামাজের পরে কোরান শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। শ্রমিক লেভেলে ছেলেদের একটা বড় অংশের দাঁড়ি আছে।
মেয়েদের স্কার্ফ পরা অর্থাৎ হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। যেন শুধু কাজের জায়গা নয়, একটি পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রত্যেকেই একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সত্যি, অসাধারন একজন মানুষ। অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত।
লেখক: অজানা