পদ্মা সেতু বাংলাদেশের নির্মাণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, নদীমাতৃক বাংলাদেশ বদ্বীপে রেলপথ নির্মান, মেঘনা রেল সেতু, গোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শাহজালাল ও যমুনা সার কারখানা, ইস্টার্ন রিফাইনারি, চট্রগ্রাম বন্দর, যমুনা সেতু, ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটোয়ার্ক নির্মাণ ইত্যাদি এক একটি বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান সময়ের মেগা প্রকল্প।

এমনকি আশির দশকের শেষে ও নব্বই দশকের শুরুতে নির্মিত মেঘনা-গোমতি সেতু গুলাও সেই আমলের বিবেচনায় মেগা প্রকল্প ছিল। রুপপুর পারমাণবিক প্রকল্প নির্ময়মান মেগা প্রকল্প।

এক একটি মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের প্রকৌশল অঙ্গনে পালক যুক্ত হয় ও মেগা প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা অর্জিত হয়।

এখনও বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের মত সক্ষমতা অর্জিত হতে বাকি আছি। অফশোরে তেল গ্যাস উত্তোলনে এখনও ভারত-চীন-মার্কিন-রাশানদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

দেশে বিদ্যুতের স্মার্ট গ্রীড করতে বাকি আছে, নবায়ন যোগ্য জ্বালনীর সমন্বিত মাষ্টার প্ল্যান সহ নদী শাসন ও উপকূলীয় আরো বহু অবকাঠামো বাস্তবায়ন হতে বাকি আছে।

যে কোন সামরিক অর্জনের বিষয় বাদই দিলাম। যদিও পৃথিবীর বহু দেশে সামরিক অর্জনকে অন্য সব অবাকাঠামো অর্জনের উপরে রাখা হয়।

বাংলাদেশের মেগা প্রকল্প নির্মাণ কারিগরি প্রকৌশল, নকশা ও বাস্তবায়ব ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে মূলত বিদেশ নির্ভর।

এটাই মূল সক্ষমতার যায়গা। অন্যান্য দেশের তুলনায় মেগা প্রকল্প কম বা বেশি যাই থাকুক না কেন, নকশা তৈরি, প্রকৌশল সক্ষমতা ও কারিগরি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা না আসা পর্যন্ত তৃপ্তির সুযোগ নেই।

আজকে আমরা আমদের প্রকল্প গুলোতে শুধু কিছু ইঞ্জিনারিং ইনপুট যুগিয়ে দিচ্ছি, বহু ক্ষেত্রে তাও পারছি না, বিদেশীরাই এসে ইনপুট ঠিক করে দেয়, বিদ্যুতের মাষ্টারপ্ল্যান করে দেয় এবং সেতুর নকশা করে দেয়। আর মূল নির্মাণ কাজ তো বিদেশীরাই এসে করে! এই দিক গুলো ৫০ বছর বয়সী দেশের ভাবতে হবে।

এক একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকে সময়, দুর্নীতির জিরো টলারেন্স, উন্মুক্ত দরপত্র আহবান, বাস্তবায়ন মানে উত্তীর্ন হতে হয়। এই তিনটি বিভাগেই আমাদের ব্যর্থতা আন্তর্জাতিক ভাবে সমালোচিত।

পদ্মা সেতুও এর ব্যতিক্রম নয়। ভূমি অধিগ্রহণ জালিয়াতি, বিশ্বব্যাংকের সাথে দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার আনাগোনা জনিত জটিলতা ও সহজ সুদের ঋণ প্রত্যাহার, একটি মাত্র দরপত্রে ঠিকাদার নিয়োগ, বারংবার সময় বৃদ্ধি ও বহু ব্যয় বৃদ্ধি সবকিছুতেই আমাদের সক্ষমতা গুলো প্রশ্নযুক্ত থেকেছে। দেশীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদের অংশগ্রহন ‘দেখুন শুনুন’ এর বাইরে খুব বেশি আগাতে পারেনি।

সেতুটি মূলত একটা চাইনিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ইমপ্লিমেন্টেশান শো। বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে (নকশায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ঋণ আছে), তবে এখানে নকশা (AECOM), কন্সট্রাকশান (চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং) ও নদী শাসন (সিনোহাইড্রো করপোরেশন) ঠিকাদার সবাই বাইরের।

স্টীল ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ সরবারহের ঠিকাদার সহ। তাই আমাদেরকে নকশা তৈরি, ইঞ্জিনিয়ারিং ইমপ্লিমেন্টেশানেও সক্ষমতা অর্জনের কথা ভাবতে হবে। কারণ আমরা যে ৫০ বছর পূর্ণ করে ফেলেছি স্বাধীনতার! এখন না পারলে আর কবে?

আমি প্রায়ই বলি, বাংলাদেশে রাস্তা, সেতু বা ব্রিজ, রাস্তার কার্পেটিং হচ্ছে উন্নয়ন। মান সম্পন্ন কর্মসংস্থান, সার্বজনীন পেনশন, সবার জন্য স্বাস্থ্য, বেকার ভাতা কিংবা সবার জন্য নিরাপত্তা এখনও উন্নয়ন দর্শন বলে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়নি।

”দিনের আলোয় চোখের সামনে ধরা দিল পদ্মা সেতু। বহুল কাঙ্ক্ষিত এই সেতুর সর্বশেষ স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) বসল আজ বৃহস্পতিবার।”

সম্ভবত উন্নয়নকে চোখে দেখানোর এই হীন পলিটক্যাল ইকোনোমির দর্শন থেকে বেরুতে পারেনি বলেই পদ্মায় টানেল না হয়ে পিলার ব্রিজ হয়েছে।

ফলে অনেক বেশি কারিগরি ত্রুটিতে পড়েছে সেতু, মাটির গুনাগুন মিলেনি, কাদার স্তরের জন্য নকশা সংশোধন করতে হয়েছে কয়েকবার। প্রাথমিক নকশায় বড় ধরনের ভুল থাকায় নির্মাণে বিলম্ব হয়েছে।

প্রতিটি পিলারে টেস্ট পাইল না করার খামখেয়ালী ছিল অমার্জনীয়। এক মূখী রেলের কারণে সম্ভবত পদ্মায় দ্রুতই আরেকটি রেল সেতু নির্মান করতে হবে বাংলাদেশকে।

‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’ বিশ্বব্যাংক বিতর্ক, নিজস্ব অর্থায়ন, নকশা ত্রুটি ও ইলিশ প্রজনন মৌসুমে কাজ বন্ধের মতো বহু আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সেতুটি এতই রাজনৈতিক মর্যাদা পেয়েছে যে, একেকটি স্প্যান ওঠানোকে রীতিমতো উদ্যাপন করা হয়েছে মহাসমারোহে। আজ এই উদজ্জাপন শেষ হল, শুরু হবে মূল সেতু উদ্ভোদনের অপেক্ষা।

২০০১ সালের ৪ জুলাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ হিসেবে ষষ্ঠ মেয়াদের বাংলাদেশ সরকার সেতুটি নিয়ে কাজ করছে এখন! বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার পদ্মা সেতুতে অবাক করা নীরবতা দেখায়।

এই দিক থেকে এর কাজ শুরু করা বর্তমান সরকার ও শেখ হাসিনার একটা বড় রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার প্রতিফলন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে পদ্মা সেতুর খরচ সমীক্ষা করে এবং অর্থায়নের মডেল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যায়।

মহাজোট সরকার সেতুটির নির্মাণে অগ্রাধিকার ও গুরুত্বারোপ করে, কিন্তু শুরুতেই দুর্নীতির অপতৎপরতার অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অতি সহজ সুদের অর্থায়ন থেকে সরে গেলে প্রকল্পে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দ্বিতীয় ভিত্তিপ্রস্তরের পরে কেটেছে প্রায় ১২ বছর। আর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পরে ২০ বছর কেটে গেলেও বাংলাদেশের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের সরকার সেতুটি উদ্বোধন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

সেতুর মূল স্ট্রাকচার শেষ হয়েছে, তারপরেও বহু রেল ও সড়ক পথ নির্মাণের বহু কাজ বাকি আছে। ফলে আরো এক থেকে দেড় বছর লেগে যাবে উদ্ভোদনে।

‘পদ্মা সেতু’ পদ্মা নদীর দু-তীরকে সংযোগকারী প্রথম সেতু নয়। ভারত এই নদীর উপর একাধিক সড়ক ও রেল সেতু করেছে কয়েক দশক আগেই। বাংলাদেশের ব্রিটিশ প্রশাসন (ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের )পদ্মার উপর মেগা প্রকল্প হার্ডিঞ্জ ব্রিজ করেছে এক শতাব্দী আগে।

দেশের প্রথম দিকের মেগা প্রকল্প হিসেবে (১৯০৯-১৯১৫)। ফলে উদ্ভোদনের আগেই উল্লাসে না মেতে আজকে মেগা প্রকল্পের নকশা, ইঞ্জিনিয়ারিং ইমপ্লিমেন্টেশান সক্ষমতা আনার উপ্লভধি তৈরি করা দরকার।

বিদেশী ‘ইঞ্জিনিয়ারিং শো’ কে প্রকৃত ‘দেশীয় ইঞ্জিনিয়ারিং শো’ দিয়ে রিপ্লেইস করা গেলেই আসবে আসল গৌরব। স্বাধীনতার ৫০ তম বর্ষে সেই সক্ষমতা না আসলেও অন্তত এই উপ্লভদ্ধিতা আসুক।

লেখকঃ ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব, পুরকৌশলী

টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক।