বর্তমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পশ্চিম পাশে নালগোলা নামক স্থানে ১৮৭৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ বাংলা সরকার ঢাকা সার্ভে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। তখন এতে ২ বছর মেয়াদী মেয়াদী ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সার্ভে কোর্স করানো হতো। এরপর সাব-ওভারসিয়ার পরীক্ষার মাধ্যমে তাদেরকে ল্যান্ড সার্ভেয়ার সার্টিফিকেট প্রদান করা হতো।

ঢাকার জমিদার নবাব আবদুল গনী (১৮১৩-১৮৯৬) তার জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা আহসানউল্ল্যাহ (১৮৪৬-১৯০১) কে জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব দেন ১৮৮৬সালে। আহসানউল্ল্যাহ ১৮৭০ সালে জমি দান করলে ১৮৭১ সালে সেই জমিতে হাজী মুহাম্মদ মহসীন ফান্ডের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মাদ্রাসা।

ঢাকার নবাব জমি দান না করলে ঢাকা মাদ্রাসা সেদিন প্রতিষ্ঠিত হত না। নবাব আবদুল গনীর ইন্তেকালের পর নিয়ম মতে জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা আহসানউল্ল্যাহ ১৮৮৬ সালে নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। পিতার মতো তিনিও জনহিতকর কাজে বিপুল অর্থ দান করেছেন। ১৯০১ সালে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করে নবাব আহসানউল্ল্যাহ ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম বিজলী বাতির ব্যবস্থা করেন।

সার্ভে স্কুলকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিলে নবাব আহসানুল্লাহ এক লাখ ১২ হাজার টাকা প্রদানের প্রতিশ্রতি দেন। জনহিতৈষী ও শিক্ষানুরাগী নবাব আহছানউল্ল্যাহ ১৯০১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন।

এরপর নবাবের জ্যেষ্ঠ পুত্র ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণকারী খাজা সলিমুল্লাহ নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি সেই অর্থ পরিশোধ করেন। তারপর ১৯০২ সালে এর নামকরণ হয় ‘ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল।’ এটিই ছিল তৎকালীন পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের প্রথম কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

সেই সময় সলিমুল্লাহ ঘোষণা দেন, তার দাদা খাজা আবদুল গণি নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত আবদুল গণি হাইস্কুল এবং ঢাকা মাদরাসা থেকে পাস করে যারা ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে ভর্তি হতে পারবে, তাদের মধ্য থেকে অন্তত চারজনকে বৃত্তি দেয়া হবে।

এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবে প্রতিফলিত হলে কৃতজ্ঞতা ও স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল। তখন এটি সিভিল, মেকানিক্যাল ও ইলেক্ট্রিক্যাল কোর্সে ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ডিগ্রী দেয়া শুরু করে।

১৯০৬ সালে বর্তমান শহিদুল্লাহ হলের পাশে এই স্কুলের ভবন নির্মাণ করা হয়।

১৯১২ সালে বর্তমান ক্যাম্পাসে এটি সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। প্রাথমিকভাবে, স্কুলটি ঢাকা কলেজের অধিভুক্ত ছিল এবং পরে এটিকে জন নির্দেশনা পরিচালকের অধীনে আনা হয়।

এরমধ্যে ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে, এই অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিংসের কাছে জোরালো দাবী করেন। এই অংশের জনগণের ক্ষোভ কমানোর জন্য, সরকার ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি বিবৃতি জারি করে আশ্বাস দেয় যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।

১৯১২ সালের মে মাসে, তৎকালীন বাংলা সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিকল্পনা সুপারিশ করার জন্য নাথান কমিটি নামে পরিচিত একটি কমিটি গঠন করে। ১৯১৩ সালে, ভারত সরকার ঢাকায় একটি সহ ব্রিটিশ ভারতে কয়েকটি শিক্ষাদান ও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে। অবশেষে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৩৮ সালে, বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক হাকিম আলীকে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর (1939-1945) সরকার বাংলায় শিল্প উন্নয়নের জন্য বড় আকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, কিন্তু দক্ষ জনশক্তির তীব্র ঘাটতি ছিল। সরকার নিযুক্ত একটি কমিটি ঢাকায় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে, যেখানে ১২০ জন শিক্ষার্থী যন্ত্র, বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক এবং কৃষি প্রকৌশলে ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রি নিতে পারবে।

ভারতীয় উপমহাদেশ ১৪-১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার পর পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন দেশে প্রকৌশলীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের অধীনে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে উন্নীত করার অনুমোদন দেন যাতে প্রকৌশল শিক্ষার অগ্রগতির জন্য সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ হয়।

হাকিম আলী তখন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে, পূর্ব পাকিস্তান সরকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে স্বীকৃতি দেয় এবং সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, কেমিক্যাল, এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ৪ বছর মেয়াদী স্নাতক ডিগ্রী এবং সিভিল, মেকানিক্যাল এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তিন বছরের ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম অনুমোদন করে। পরবর্তীতে টেক্সটাইল ও এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিবর্তে ধাতব প্রকৌশলবিদ্যা শুরু হয়।

১৯৫১ সালে, টিএইচ ম্যাথুম্যান পরবর্তী অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। ড. এম. এ. রশিদ ১৯৫৪ সালে কলেজের প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৫৬ সালে, কলেজটিতে একটি নতুন কোর্স কারিকুলাম এবং সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৫৭ সালে স্নাতক ডিগ্রির জন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০ থেকে বাড়িয়ে ২৪০ করা হয় এবং ১৯৫৮ থেকে ডিপ্লোমা কোর্স বাদ করা হয়।

৫ ও ৬ এর দশকে উত্পাদন ও শিল্প প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকার শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ড. রশিদ এই কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে, ড. রশিদ নতুন প্রতিষ্ঠিত কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।

শরীফ কমিশন দুটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছিল: আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে ঢাকায় ইপিইউইটে উন্নীত করে একটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ব পাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রিকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েকদিন পর, কমিশনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এই অংশে একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি প্রকল্প কমিটি গঠন করে।

এর সদস্যরা ছিলেন শিক্ষা সচিব জনাব আলী হাসান, কারিগরি শিক্ষা পরিচালক ড. রশিদ, আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. বার্গেলিন এবং পাকিস্তান সরকারের কারিগরি শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ভি. জি দেসা। প্রকল্প কমিটির সকল সভা ডঃ বার্গেলিনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়।

সাক্ষাতের সময়, টেক্সাস এএন্ডএম কলেজের ভিজিটিং প্রফেসর ড. বার্গেলিন তার নিজের খরচে দুপুরের খাবার এবং বিকেলের নাস্তার প্রস্তাব দেন। সেই প্রকল্প কমিটির সুপারিশ অনুসারে, ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি (ইপিইউইটি) অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১ জারি করা হয়।

এইভাবে স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ EPUET এ আপগ্রেড করা হয়েছিল। এবং EPUET ১ জুন ১৯৬২ সালে একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এটি তখন পুর্ব পাকিস্তানের চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।

ড. রশিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন।

টেক্সাসের এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল কলেজ (টেক্সাস এএন্ডএম ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে) এর সাথে একটি অংশীদারিত্ব তৈরি হয়েছিল এবং এএন্ডএম থেকে অধ্যাপকরা তখন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে আসেন। তখন EPUET যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক, সিভিল, ধাতুবিদ্যা, এবং রাসায়নিক প্রকৌশল এবং স্থাপত্য বিষয়ে ডিগ্রী দিতে থাকে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, EPUET এর নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (BUET) রাখা হয়।

মুসলিম লীগ সরকার ১৯৬২ সালে প্রদেশের নামে না করলে হয়ত বুয়েট আজো আহছানউল্ল্যাহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নামেই পরিচিত থাকতো। ১৯০২ সালে নবাব সলিমুল্লাহর দান করা জমিতে তারই অর্থে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলটি পর্যায়ক্রমে উন্নীত ও সম্প্রসারিত হয়ে আজকের বুয়েটে পরিণত হয়েছে। উৎস তালাশ করলে নবাব সলিমুল্লাহই বুয়েটের আদি প্রতিষ্ঠাতা।

আর প্রকৌশল স্কুল, প্রকৌশল কলেজ হিসেবে পরিচিতি থেকেই Engineering and Technology নামকরণ করার পরেও বুয়েট শুধুমাত্র “প্রকৌশল” বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই প্রচলিত। BUET এর নামে কোনো প্রযুক্তি নেই!

 

সংযুক্তিঃ The Evolution Of BUET

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ : একটি জীবন-একটি ইতিহাস

বুয়েট-ও-ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ের-প্রতিষ্ঠাতা-নবাব-স্যার-সলিমুল্লাহ-উপেক্ষিত-কেন?

Wiki/Bangladesh_University_of_Engineering_and_Technology

Star Campus :(thedailystar.net)