খুব সিম্পল ও সস্তা তথ্য। সবাই মোটামুটি জানে।।তবুও সমাজের জ্ঞানী গুনি ব্যক্তিরা মাঝে মাঝে যে প্রশ্ন তোলে সেই প্রশ্নের উত্তর এত সিম্পল হওয়ার পরেও কেন তারা খুজে পায় না? ইউজিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি আবদুল মান্নান স্যার এক টক শোতে বললেন– উনি ভেবেই পাচ্ছেন না, ড: ইউনুস শান্তিতে কেন নোবেল পেল? অর্থনীতিতে পেলে তাও নাকি একটা অর্থ খুজে পেতেন। একই রকম প্রশ্ন করতে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় প্রাক্তন ভিসি আফেরিন সিদ্দিকি স্যারকে।

এর বাহিরেও আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতা কর্মী সহ সাধারণ অনেক মানুষেরও একই প্রশ্ন। কারণ প্রফেসর ইউনূস একজন অর্থনীতিবিদ তাই উনার নোবেল পাওয়ার কথা অর্থনীতিতে, শান্তিতে কেন? তাছাড়া শান্তিতে পুরষ্কার যেহেতু নানা কারণে বিতর্কিত তাই ড: ইউনুসের নোবেল ও অন্য কোন উপায়ে পেয়েছে কিনা সেই সন্দেহ ঘনীভূত হওয়ার সুযোগ আছে।

নরম্যান বোরলগের নাম শুনেছেন? আমার ধারণা অনেকেই শুনেন নাই। এইবার যদি জিজ্ঞেস করি গ্রীন রেভুলেশন শব্দটা শুনেছেন? আমার ধারণা সবাই শুনেছেন বলবেন। কারণ গ্রীন রেভুলেশন মানে আধুনিক মেকানাইজড কৃষি যার মাধ্যমে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩-৪ গুন।বিশ্বের কোটি কোটি অনাহারী মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেয়া গেছে।

পৃথিবীর দূর্ভিক্ষ প্রায় বিদায় নিয়েছে। কত বাহারি রকমের খাদ্য এখন আমাদের টেবিলে। যদিও গ্রীন রেভুলেশন নিয়েও কথা আছে।।এটা পরিবেশ ও মাটির ক্ষতি করে। এগ্রিকালচার কে ইনপুট নির্ভর করে সাধারণ কৃষকের হাত থেকে কৃষি কর্পোরেশনদের হাতে নিয়ে গেছে।।জীব বৈচিত্র‍্য এর ক্ষতি হয়েছে। এইসব সমালোচনা মাথায় নিয়েও পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এই ম্যাকানাইজড কৃষিকে গ্রহণ করেছে, খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি অনাহারী মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে।

নরম্যান বোরলগকে বলা হয় গ্রীন রেভুলেশনের জনক। মুলত একজন প্ল্যান্ট জেনেটিস্ট যিনি তার হাইব্রিড ভ্যারাইটির গম আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের ইশ্বর রুপে আবির্ভুত হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বোরলগ নোবেল পুরুষ্কার পেয়েছিলেন। তবে জীববিদ্যায় নয়। উনি নোবেল পেয়েছিলেন শান্তিতে৷ কারণ নোবেল কমিটি মনে করেছিলো ক্ষুধা হচ্ছে সমাজের হানাহানি মারামারি নানা অশান্তির রুট কজ। তাই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি আসলে বৈশ্বিক শান্তির একটা গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ।

ওয়ানগারি মাথাই এর নাম শুনেছেন? উনি আমার শিক্ষক ছিলেন। সরাসরি শিক্ষক না, আমি যখন সুইডেনের স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, উনি আমাদের দুইটা ক্লাস নিয়েছিলো ইনভায়রনমেন্টালিজমের উপর৷ এই কেনিয়ান পরিবেশবিদ ও মন্ত্রী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন গাছ লাগিয়ে৷ কারণ আফ্রিকার যে মরুকরণ তার মুলে আছে বন ও বৃক্ষ নিধন। সেই খান থেকে উৎপত্তি নানা হানাহানি, সুপেয় পানির দখল নিয়ে গৃহযুদ্ধ। মাথাই তাই মহিলাদের নিয়ে ১ কোটি গাছ লাগিয়েছিলো। কারণ গাছ শুধু মরুকরণ ঠেকায় না, সাথে হিলি ওয়াটারশেডকেও রক্ষা করে। আর হিলি ওয়াটারশেড লক্ষ কোটি মানুষের সুপেয় পানির উৎস।

ওয়ানগারি মাথাই শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলো, কারণ নোবেল কমিটি মনে করেছিলো বন নিধন, মরু করণ, সুপেয় পানির উৎস রক্ষা এইগুলো আফ্রিকার জাতিগত দাংগার অন্যতম রুট কজ।।তাই এখানে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি আনতে হলে প্রয়োজন এমন উদ্যোগ যা এই সমস্যা গুলোর মুলকে এড্রেস করে।

ড: ইউনুস ২০০৬ সালে গ্রামীন ব্যাংকের মাধ্যেম ক্ষুদ্র ঋণ কার্য্যক্রমের সফল উদাহরণ হিসাবে নোবেল পায়।।ক্ষুদ্র ঋণ মুলত সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র নারীদের বিনা জামানতে ঋণ দেয়৷ সেইসব গল্প আর বললাম না, সবাই জানে৷ কিন্ত কেন ঋণ দেয়? দারিদ্রতার দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আনতে৷ ড: ইউনুস সফল হয়েছিলেন। এবং তার এই ক্ষুদ্র ঋণ মডেল পুরো বিশ্বে সাড়া ফেলেছিলো।

দেশের প্রায় সব এনজিও এই মডেল গ্রহণ করেছে।।নানা দেশের সরকার করেছে।।এই মডেলের দূর্বলতা নাই, এমন না।।তবে এটা একই সাথে চরম দারিদ্রতা থেকে উন্নতির একটা পথ দেখায় আবার নারী উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখে।। এই মডেলের সুদের হার, যেভাবে দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠাবে ক্লেইম করা হয় সেভাবে হয়তো হবে না– এইগুলো নিয়ে সমালোচনা করা যায়।

কিন্ত এই মডেল কার্যকর না- এইটা বলা শুধু ডাহা মিথ্যা না, বরং জঘন্য অপরাধ।।কারণ সমাজের এই শ্রেনীর জন্য এর থেকে ভালো মডেল এখন পর্যন্ত কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি। তাই সমালোচনা হতে পারে এই মডেলকে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় কিন্ত এই মডেলের মাধ্যমে দারিদ্রতা একটুও কমেনি এটা দাবী করা জঘন্যতম মিথ্যা গুলোর মধ্যে একটা।। এখন প্রশ্ন ড: ইউনুসকে কেন শান্তিতে নোবেল দিলো, কেন অর্থনীতিতে নয়?

প্রথমত অর্থনীতিতে নোবেল দেয় সাধারণ কেউ অর্থনীতির মৌলিক কোন তত্ত্ব, নীতি আবিষ্কার করে সেটার স্বার্থক প্রয়োগ দেখালে। ড: ইউনুস নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করেননি। ঋণ কিংবা লোন সমাজে প্রচলিত একটা পদ্ধতি৷ এটা ব্যাংকিং সিস্টেমের একটা উপাদান। আর ব্যাংকিং সিস্টেম ইউনুস আবিষ্কার করেনি কিংবা উনার তত্ত্ব ব্যাংকিং সিস্টেমে কোন মৌলিক পরিবর্তন আনেনি৷ উনি যেটা করেছেন, সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র অংশকে ব্যাংকিং সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে এসেছেন যারা আগে এই সিস্টেমের বাহিরে ছিলো।।

ব্যাংকিং সিস্টেমে মুলত সম্পদ জানামতের বিপরীতে ঋণ দেয়। তাই এটা ” মানি বিগেটস মানি” সিস্টেমে চলে৷ যার সম্পদ আছে সেই এই সিস্টেমের সুবিধাভোগী। ড: ইউনুস জানামত বিহীন ব্যাংকিং সিস্টেমে গরীবের “ট্রাস্ট ও উদ্যম”কে জামানতের বিকল্প হিসাবে দাড় করিয়ে তাদের ব্যাংকিং সিস্টেমে নিয়ে এসেছেন। কি চমৎকার উদ্যোগ৷ ইনটেঞ্জিবল এসেটকে ট্যাঞ্জিবল এসেটে কনভার্ট করলেন। এবং পুরো বিশ্বকে দেখালেন এই লোকগুলোর উপর ভরসা করা যায়।

আগে এদের ঋণ পাওয়ার কোন অধিকারই ছিলো না নরমাল ব্যাংকিং সিস্টেমে। এবং ৯৫% এর উপর লোন রিকোভারী করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন। বিশ্বের বড় বড় তাত্ত্বিক, গবেষকরা হা হয়ে গেল। ড: ইউনুস নতুন কিছু আবিষ্কার করেনি, তত্ত্ব ও দেয়নি।।শুধু এক্সিজটিং সিস্টেমকে মোডিফাই করেছেন।

উনার এই মোডিফিকেশন শুধু অর্থনীতি নয়, হিউম্যান সাইকোলজি, ডেভলেপমেন্ট স্টাডিজ, বিহেভিরিয়াল ইকোনমিক্স এর নানা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে রিভাইজ করতে বাধ্য করলো।।তাই ইউনুস কিছু আবিষ্কার না করেও বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষগুলোর “আস্থা, ঋণ ফেরত দেয়ার সততা” ” এগিয়ে যাওয়ার অদম্য উদ্যম” কে সারা বিশ্বের সামনে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন– মানুষকে বিশ্বাস করা যায়, যদি সিস্টেম ডেভেলপ করা যায়।

যেখানে মডার্ণ ইকোনমিক্স দাঁড়িয়ে আছে কোলেটারাল, রিস্ক এভারশন ও সেলফিশ রেশনালিটির উপর৷ ড: ইউনুস দেখালেন যে মানুষগুলোকে সমাজ বিশ্বাস করে না, সমাজে মানুষের প্রতিষ্ঠিত ভাবনা ” অভাবে স্বভাব নষ্ট”, যে মানুষগুলোকে সবাই নাক সিটকিয়ে ভাবে- চুরী চামারী করে এরা, এদের দিয়ে কিছু হবে না। সেই মানুষগুলোকে কর্মীর হাতে রুপান্তর করেছেন। উদ্যোক্তা বানিয়েছেন।

সবক্ষেত্রে সফল হয়েছেন বলা যাবে না৷ তবে উনার সফলতার হার স্টাটিস্টিকালি সিগনিফিকেন্ট। পৃথিবীর কোন সিস্টেম ফুল প্রুফ না। গ্রামীন ব্যাংক মডেল ও ফুল প্রুফ না।।তবে এই মডেল অন্য দারিদ্র বিমোচন মডেল গুলো থেকে বেশি কার্যকর, এটা যারা এই মডেল গ্রহণ করেনি তারাও স্বীকার করবে।

এখন তাহলে শান্তিতে কেন নোবেল পেল ড: ইউনুস? ঐ যে “পোভার্টি ইজ দ্যা রুট অব অল এভিল”৷ ১৯৭০ এ বোরলগকে যখন নোবেল দেয় তখন এই বিতর্ক উঠেছিলো৷ কিন্ত নোবেল কমিটি কনভিন্সড ছিলো ক্ষুধা দূর করা থেকে বড় শান্তি প্রতিষ্ঠা আর কি হতে পারে?

ঠিক একই ভাবে ড: ইউনুসের ক্ষেত্রেও নোবেল কমিটি জোরালো ভাবে একমত হয়েছিলো “দারিদ্র দূর করা থেকে সমাজ, রাষ্ট্রে ও বিশ্বে বড় শান্তির কাজ আর কি হতে পারে? দারিদ্রতাই সমাজে অশান্তির সবচেয়ে বড় কারণ।

না, তারপরেও অনেকে কনভিন্স হবে না।আবদুল মন্নান স্যার, আরেফিন স্যার জ্ঞানে গুনে আমার থেকে অনেক বড়। তারপরেও উনারা এই সিম্পল হিসাব বুঝবে না। উনারা যুক্তি দিবে – শান্তি পুরুষ্কার মানেত যুদ্ধ,বিগ্রহ, রোহিংগা, আদিবাসী, সাদা কালো এইসব ইস্যু৷ ক্ষুদ্র ঋণ কোন অর্থে শান্তি পুরষ্কার পায়? ঠিক স্যার, আসলেই কেন পাইলো?

স্যার, চোখের রাজনৈতিক চশমাটা খুলে ফেললে বুঝবেন, নয়তো ড: ইউনূস যদি আওয়ামী লীগে জয়েন করে কাউকে ” আপা” আপা” বলতো তাহলে বুঝতেন।। কখন, কিভাবে আপনারা বুঝবেন সেটা আপনারা ছাড়া দেশের সবাই বুঝে,এতটাই বুঝদার আপনারা।।

 

লেখকঃ বাতেন মোহাম্মদ