চাঁদ আমাদের গ্রহের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চাঁদের প্রতি আকৃষ্ট। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ মিশনের মাধ্যমে মানুষ প্রথমবারের মতো চাঁদে পা রাখে। এরপর আরও বেশ কয়েকটি দেশ চাঁদে অভিযান চালায়। তবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এখনও কোনো অভিযান চালানো হয়নি।

আজ থেকে প্রায় ৫৪ বছর আগে, ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মত চাঁদের বুকে নেমেছিলেন নাসার দুই নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং আর এডউইন অলড্রিন, আর লুনার মডিউলে করে চাঁদ প্রদক্ষিণ করছিলেন তৃতীয় নভোচারী মাইকেল কলিন্স। এর পরে চাঁদের বুকে শেষবার মানুষ নেমেছিল ১৯৭২ সালে। যদিও চাঁদে অভিযান নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তোলা হয়। কেউ মনে করেন যে সত্যিই মানুষ চাঁদ এ গিয়েছিল। আবার কেউ মনে করেন যে চাঁদে অবতরণ করার ঘটনাটি সম্পুর্ন মিথ্যা!

যাক সত্য মিথ্যা বিষয়ে আমি যাচ্ছি না। মানুষের মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে যে ওইসময় চাঁদে অভিযান এর পরেও এখন কেন চাঁদ অভিযানে এর আগ্রহ দেখাচ্ছে সারা বিশ্ব। সাম্প্রতিক সময়ে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সাথে সমন্বয় করে Artemis নামে একটা মিশন এর কথা প্রকাশ করে, যেখানে প্রথমবারের মত একজন নারী মহাকাশচারির চাঁদে প্রেরণের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এবং বলা হয় যে এই মিশনটি হবে অন্যান্য মিশন থেকে সম্পুর্ন আলাদা এবং অনেক তথ্যবহুল।

১৯৭২ সালে যখন চাঁদে গিয়েছিল তখন তারা ছিল মাত্র তিনদিন, এবং তারা ল্যান্ড করেছিল চাঁদের উত্তর মেরুতে । এই কম সময়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু Artemis মিশনে মহাকাশচারীরা প্রায় সপ্তাহব্যাপি চাঁদে ক্যাম্প করবে, আর সবচাইতে বড় বিষয় হলো এই ক্যাম্পটি করা হবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে।

সম্প্রতি (২৩ আগস্ট) চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেছে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (ইসরো) চন্দ্রযান-৩। শুধু ভারত নয়, চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অভিযান নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। চাঁদের দক্ষিণ মেরুকে ঘিরে কেন এত রহস্য? কী আছে সেখানে? কেনইবা সবাই দক্ষিণ মেরুতে অভিযান চালাতে চায়?

বৈজ্ঞানিকরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই পানির অনু দিয়ে তৈরি বরফের সন্ধান পেয়েছেন, এছাড়াও এই অংশে রয়েছে প্রচুর খনিজের সম্ভার। চাঁদে বাসযোগ্য নগরী তৈরি, চাঁদের খনিজ আহরণ এবং মঙ্গল অভিযানের বেসক্যাম্প তৈরির ভাবনাও রয়েছে চাঁদের এ মেরুকে ঘিরে।

অনেক আগেই চাঁদে পাড়ি জমিয়েছে মানুষ, দীর্ঘ সময় ধরে হচ্ছে নানামুখী গবেষণা। বর্তমানে মানুষ চাঁদে বসতি বানাতে চাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা চাঁদের কোনো এক অংশে যদি পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায় তবে সেখানে বসবাস করতে পারবে মানুষ এবং চাঁদ থেকে সংগ্রহ করা যাবে মূল্যবান খনিজ পদার্থ। তখন অভিযান চালানো যাবে মঙ্গল গ্রহেও।

চাঁদে যদি পানি পাওয়া যায়, তাহলে সেখানে অভিযানের গতি আরো বেড়ে যাবে। চাঁদের পানি ভেঙে জ্বালানির জন্য হাইড্রোজেন ও শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য অক্সিজেনে রূপান্তরিত করা যাবে। চাঁদে খননকাজ করাসহ মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার জন্যও কাজে আসবে এই পানি।

চাঁদে কি আসলেই পানির অস্তিত্ব রয়েছে কি না এ নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই মানুষের। অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষণা সংস্থা এ প্রশ্নের উত্তর জানতে নিরলস গবেষণা করে চলেছেন। ১৯৬০-এর দশকে অ্যাপোলো অভিযানের সময় বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, চাঁদে পানি থাকলেও থাকতে পারে। ১৯৭০-এর দশকে অ্যাপোলো অভিযানের সময় বিজ্ঞানীরা চাঁদ থেকে নানান উপাদান সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন।

২০০৮ সালে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সেসব উপাদান পরীক্ষা করলে তাতে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি পান। ২০০৯ সালে ভারতের প্রথম চন্দ্র অভিযানে চন্দ্রযান-১ এ থাকা নাসার যন্ত্রের মাধ্যমে চাঁদে পানি শনাক্ত হয়। সে বছরই নাসার গবেষকরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পানির খোঁজ পান। এর আগে, ১৯৯৮ সালে লুনার প্রসপেক্টর-এক চন্দ্রাভিযানে প্রমাণ মেলে যে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে থাকা ছায়াযুক্ত গর্তগুলোতে পানি ও বরফের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।

২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ তো বটেই আগেও একাধিক চন্দ্রাভিযানে চাঁদের এই অংশে পানির উপস্থিতি নজরে এসেছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রাচীন এই বরফ থেকে চাঁদ সৃষ্টির বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য জানা যেতে পারে।

চাঁদের গহ্বর বা ক্রেটারে রয়েছে খনিজের ছড়াছড়ি। ‘মুন মিনারালোজি ম্যাপার ইনস্ট্রুমেন্ট (এম-থ্রি)’ দিয়ে চালানো অভিযানে চাঁদের পৃষ্ঠে হদিশ মিলেছে বিভিন্ন খনিজের। এই হদিশ দিয়েছিল চন্দ্রযান-১। ২০০৯ সাল থেকে নাসার ‘লুনার ক্রেটার অবজারভেশন অ্যান্ড সেন্সিং স্যাটেলাইট’র সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল এলআরওকে।

১০০ মিটার রেজোলিউশনে চাঁদের পিঠের ৩-ডি ম্যাপিং করেছে এলআরও। সেখানেই ধরা পড়েছে, চাঁদের পৃষ্ঠের ০.৫ মিটার থেকে ২ মিটার গভীরে জমে আছে লোহা ও টাইটেনিয়াম অক্সাইড। এছাড়াও চাঁদের গহ্বরগুলোতেও খোঁজ মিলেছে ধাতুর।

চাঁদের পৃষ্ঠে কী কী খনিজ রয়েছে তার সন্ধান করতেই ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডার বিক্রম ও রোভারকে পাঠিয়েছিল ইসরো। কিন্তু চাঁদের মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিক্রম-২। সেবার ব্যর্থ হয় মিশন। তবে এবারের মিশন সফল হয়েছে। চন্দ্রযান-৩ এর রোভার সেই একই কাজ করবে। কাজ হবে চাঁদের রুক্ষ, পাথুরে পৃষ্ঠে ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম ও টাইটেনিয়ামের মতো খনিজ রয়েছে কিনা তার সন্ধান করা।

১৯৬৭ সালে ইউনাইটেড নেশনের বহির্বিশ্ব চুক্তি বা আউটার স্পেস ট্রেইটি অনুযায়ী, কোনো দেশ চাঁদকে নিজেদের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করতে পারবে না। তবে চাঁদের বুকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালানোর ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। ১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রংরা নেমেছিলেন চাঁদের উত্তর মেরুর একটি অংশে। এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত চাঁদে যে কয়েকটি সফল অভিযান হয়েছে সবই চাঁদের নিরক্ষীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে।

চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এসব অন্ধকার ছায়াযুক্ত অঞ্চলে ২০২৪ সালের নভেম্বরে অভিযান চালাবে নাসা। ভাইপার নামের সেই অভিযানে সেসব অন্ধকার গর্তে আলো ফেলে এর রহস্য উন্মোচন করা হবে। সেসব গর্তে আসলেই পুরোটা বরফ নাকি বালির সাথে মিশানো ক্রিস্টাল তা জানা যাবে। ফলে চাঁদের এই মেরুকে ঘিরে প্রতিযোগিতার যেন কেনো শেষ নেই।

 

Sadman Mahi
NITER, IPE