ইউজিসির বলছে দেশে বর্তমানে ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।আছে। এর মধ্যে গত বছর পর্যন্ত আরও ৮৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আবেদন জমা পড়ার তথ্য দিয়েছে ইউজিসি।
কারা এই আবেদন করেছেন? আবেদনকারীরা হলেন সংসদ সদস্য, সরকারি দলের নেতা, সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী।
ইউজিসির বলছে সরকারের পরিকল্পনা হলো দেশের প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় করা। Would you believe it? কিন্তু বিশ্বাস করি আর না করি আমাদের সরকারেরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই উপজেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা নিয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলাতেই যত কলেজ আছে তার প্রায় সবকটিতেই বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স পড়ানো হয়। শেখানো হয় কিনা সেই প্রশ্ন করে লজ্জা দিবেন না।
অনার্স এবং মাস্টার্স লেভেলে কারা পড়াবে? এইসব কলেজগুলোতে প্রায় সকল শিক্ষকই শুধু মাস্টার্স পাশ। এই মাস্টার্স ডিগ্রীধারীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের পড়াশুনা অর্থাৎ অনার্স/মাস্টার্স পড়ানো হয়।
এমনকি অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালওয়েও মাস্টার্স ডিগ্রীধারীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের পড়াশুনা অর্থাৎ অনার্স/মাস্টার্স পড়ানো হয়। সারা পৃথিবীতে মাস্টার্স ডিগ্রীধারীরা বড়জোর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যোগ্যতা প্রমান সাপেক্ষে এদের কেউ কেউ পূর্ণ শিক্ষক হতেও পারে।
আমরা জানি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক থেকে ছাত্রদের মাঝে জ্ঞানের প্রবাহ তখনই সম্ভব যদি শিক্ষকের জ্ঞান ছাত্রদের জ্ঞান থেকে অনেক বেশি থাকে। এইটা অনেকটা পানির প্রবাহের মত। পানির প্রবাহের জন্য যেমন উচ্চতর গ্রেডিয়েন্ট বা ঢাল লাগে তেমনি জ্ঞানের প্রবাহের জন্যও জ্ঞানের ঢাল লাগে।
মাস্টার্স পাশ শিক্ষক যদি মাস্টার্সের ক্লাস নেয় তাহলে জ্ঞানটা কিভাবে প্রবাহ হবে কেউ একটু বুঝবেন প্লিজ? এমনকি অনার্সের প্রথম দ্বিতীয় ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ক্লাসই মাস্টার্স ডিগ্ৰীধারীদের দিয়ে পড়ানো উচিত না।
ছাত্র যখন ক্লাসে থাকে তখন তাকে বুঝতে হবে যে শিক্ষক তার চেয়ে অনেক বেশি জানে। এর ফলে সম্মানের গ্রেডিয়েন্ট বা ঢালও তৈরী হয়। জ্ঞানের ঢাল এবং সম্মানের ঢাল দুটোই একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কিত।
তাহলে কি দাঁড়ালো? জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলার মাধ্যমে আমরা আসলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের সাথে প্রতারণা করছি। এতে কেবল আমরা সার্টিফিকেট বিতরণের দোকান খুলছি। যেই সার্টিফিকেট দিয়ে এরা কোন চাকুরী পাবে না।
নিজেদের শিক্ষিত ভেবে এরা সাধারণ কায়িক পরিশ্রমের কাজ যেমন কৃষি কাজ করতে অনীহা হয়। এরা আদতে একটা frustrated প্রজন্ম হিসাবে বড় হয়। ফলে এদের একটা অংশ মাদকে আসক্তি হয়ে পরে নতুবা নানা ক্রাইমে জড়িয়ে সমাজের বার্ডেন হয়ে যায়।
জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগে জরিপ করে দেখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার মত যোগ্য কতজন শিক্ষক এই দেশে আছে। যদি যথেষ্ট না থাকে বিদেশীদের নিয়োগের রাস্তা উম্মুক্ত করুন। দেশি বিদেশী শিক্ষক নিয়োগ দানের মাধ্যমে উচ্চমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী করুন।
একটি মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান বোঝার চেষ্টা করুন। সিঙ্গাপুর এমনি এমনি সিঙ্গাপুর হয়নি। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর নামক একটি বিশ্ববিদ্যালয় সিঙ্গাপুরকে সিঙ্গাপুর বানিয়েছে।
অক্সফোর্ড কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ইংল্যান্ডকে ইংল্যান্ড বানিয়েছে। হার্ভার্ড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন, ইয়েল ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ই আমেরিকাকে সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বানিয়েছে।
নিজের দেশের দিকে তাকান। পুরান ঢাকায় একটি স্কুল ছিল এবং এখনো আছে। যদিও আগের মত নাই। স্কুলটির নাম সেন্ট গ্রেগরী স্কুল। একটি মিশনারি স্কুল। এই স্কুল থেকে পাশ করেছে তাজউদ্দীন আহমেদ, ড. কামাল হোসেন, ড. বদরুদ্দোজা, অমর্ত্য সেন, জামিলুররেজা চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মাহফুজ আমান, আলী জাকের প্রমুখ।
স্বাধীনতার পর এমন আরেকটি স্কুলের নাম বলুনতো যেখান থেকে এই মাপের মানুষ জন্ম নিয়েছে। একটি কলেজের কথা বললে হলিক্রস কিংবা নটরেডম কলেজের নাম সবার আগে আসে। এদুটিও মিশনারি কলেজ।
আমাদের ক্যাডেট কলেজগুলোও মোটাদাগে একসময় ভালো ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এই সাফল্যগুলো এখন কেবলই ইতিহাস।
যেমনই হোক বাংলাদেশকে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট ব্যতীত কল্পনা করে দেখুনতো? এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মানও দিন দিন নিম্নগামী। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মানও নিম্নগামী।
এই নিম্নগামিতাকে রুখতে হলে প্রথমে নিম্নগামী যে হচ্ছে সেটা মানতে হবে। তারপর কিভাবে এর থেকে উন্নতি করা যায় সেই জন্য পরিকল্পনা নিতে হবে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিঃসন্দেহে এই নিম্নগামিতাকে আরো ত্বরান্বিত করবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মানের সাথে compromise করা যায় না।
এরই মধ্যে শুনছি আমাদের গুণধর ইউজিসি নাকি দেশে ১৪টি বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টাডি সেন্টার চালুর অনুমোদন দিতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিদেশি একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘স্টাডি সেন্টার’ চালুর অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
আরও দুটির বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আর মোট আবেদন জমা পড়েছে ১৪টি।
কারা এই স্টাডি সেন্টারগুলো খোলার জন্য আবেদন করেছে? অস্ট্রেলিয়ার মনাশ কলেজের স্টাডি সেন্টারের জন্য আবেদন করে এডুকো বাংলাদেশ লিমিটেড। এডুকো প্রস্তাবিত এলাকা দিয়েছে বসুন্ধরায়।
লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ডার্বের স্টাডি সেন্টার করার জন্য আবেদন করে বিএসি ইন্টারন্যাশনাল। তারা প্রস্তাবিত ঠিকানা দিয়েছে ধানমন্ডি। গুলশান-২ এলাকার জন্য লন্ডন স্কুল অব কমার্সের স্টাডি সেন্টারের আবেদন করেছে এশিয়ান সেন্টার ফর ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
এদের কাউকে কি শিক্ষাবিদ, ফিলানথ্রপিস্ট বলা যায়? এদের কারো মধ্যে দেশের জন্য কোন কমিটমেন্ট আছে বলে মনে হয়? এরা শিক্ষা বিস্তার নয় বরং কেবলই টাকা কামানোর মানসিকতা নিয়ে এইসব সেন্টার খোলার জন্য আবেদন করেছে।
পৃথিবীর কোথায় বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের এইরকম স্টাডি সেন্টার আছে? যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম হলো ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়। সেই ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের সাথে মিলে Yale-NUS College স্থাপন করেছে।
Texas A&M University কাতারে তাদের শাখা খুলেছে। যেটি স্টাডি সেন্টার না। এমন আরো অনেক আছে। কিন্তু বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার খুব ভালো কোন উদ্যোগ হতে পারে না। এখানে ইউনিভার্সিটি অফ ডার্বি কি বিদেশী শিক্ষক নিয়োগ দিবে?
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের রেঙ্কিং-ই ৮০০-র উপরে। এদের কাজই উন্নয়নশীল দেশে স্টাডি সেন্টার খুলে টাকা কামিয়ে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া। তাদের ৩০০টির উপরে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড স্টাডি সেন্টার আছে। এরা তাহলে কিভাবে মান বজায় রাখবে?