আজকে ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের ৩৯০ বছর পূর্ণ হইল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন কারনে তা নিয়া লেখিনা সাধারণত। কিন্তু বলতে দ্বিধা নাই যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। এবং আজকে বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিদেশে (আসলে, ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে) উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী তরুণ তরুণীদের কিছু পরামর্শ দিবো।
তবে, এই পরামর্শ শুধু তাদের জন্যে, যাদের পড়াশোনা ও গবেষণার প্যাশন আছে। সবচাইতে কম আইএল্টস স্কোর নিয়া কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশে যাওয়া যায়, কোন দেশে পড়ালেখার পর সেটলড হওয়া সহজ, এই ধরণের ব্যাপারগুলা যাদের প্রধান চিন্তার বিষয়, এই পরামর্শগুলা তাদের জন্যে নয় (বলতাছিনা যে এই ব্যাপারগুলা নিন্দনীয়, যাস্ট উদ্দেশ্য হিসাবে আলাদা)।
পরামর্শগুলা হলঃ
১। স্কুল জীবন থেকে পরিকল্পনা শুরু করুন। নাইলে বেহুদা অনেক সময় নষ্ট হবে। আপনি বাংলাদেশের মানুষ। প্রিভিলেজের অভাবে উন্নত বিশ্বের সমান মেধার তরুণদের চাইতে অনেক পেছন থেকে আপনার দৌড় শুরু করতে হবে। সুতরাং, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি শুরু করাই ভাল।
২। স্কুলের পড়াশোনা ও গ্রেড গুরুত্বপূর্ণ। তবে জিপিএ ৫ ব্যাপারটাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে হিসাব করাই ভাল। না পাইলে ভেঙে পড়বেন না। দেশের বাইরে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করলে জিপিএ ৫ এর চাইতে কিছু কম পাইলেও অসুবিধা নাই।
শুধু খেয়াল রাখবেন, গ্রেড যেন খুব বেশি নিচে নাইমা না যায়। এভারেজে ১০ এ ৮ রাখার চেষ্টা করুন। অন্ততপক্ষে ৭.৫। এইটুকু থাকলে দুনিয়ার যেকোন ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন বা স্কলারশিপ অর্জনের প্রথম ধাপটা পুরণ হয়ে যায়।
৩। প্রথমে নিজের পছন্দের বা প্যাশনের ডিসিপ্লিনটা খুঁজে নেন (এমনকি তা যদি ইন্টারডিসিপ্লিনারি কোন পড়াশোনাও হয়)। তারপরে দেখেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে তা ভাল পড়ায়। তারপরে সেইগুলাতে এপ্লাই করেন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয় কোন দেশে, তা একটা সেকন্ডারি ব্যাপার।
কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা সাধারণত এর উলটা কাজটাই করে। তবে, আপনার যদি পড়াশোনার নেশা থেকে, গবেষণার ইচ্ছা থাকে, তবে এই উল্টা পথে না হেটে নিজের প্যাশনের পেছনে সময় দেন। ঐটাই সবচাইতে প্রাইমারি কাজ।
৩। আইএল্টসে টার্গেট রাখবেন মিনিমাম ৭। কোন পরীক্ষাতেই যেন ৭-এর নিচে না নামে স্কোর, তা খেয়াল রাখবেন। এইটুকু বজায়ে রাখলে, আপনার এভারেজ ৭-এর উপরে উঠে যাবে খুব সহজেই।
আর এই এভারেজ থাকলে দুনিয়ার সবচাইতে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতেও আপনি এপ্লাই করতে পারবেন। স্কলারশিপগুলাতেও। অন্তত, আইএলটস স্কোর কম থাকার কারনে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তখন আপনার নষ্ট হবেনা।
৪। মনে রাখবেন, মোটিভেশনাল লেটার জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলায় সারা দুনিয়ার অনেক ভাল ভাল শিক্ষার্থীরা এপ্লাই করে। ফলে কম্পিটিশনও হয় অনেক। কিন্তু কনফিডেন্স হারাইবেন না। আপনার মোটিভেশন যদি ঠিকঠাক থাকে, তাইলে এই কম্পিটিশনে জেতার সম্ভাবনা বেশ ভাল।
বাংলাদেশের তরুণরা মেধায় মোটেই পিছায়া নাই। তারা পিছায়া থাকে প্রস্তুতিতে। একটা ভাল মোটিভেশনাল লেটার তাই অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সমান মেধা ও গ্রেডের অন্যদের সাথে কম্পিটিশনে আপনাকে অনেকখানি আগাইয়া দেবে একটা ভাল মোটিভেশনাল লেটার।
৫। যেই সাবজেক্টে পড়তে চান, তা নিয়া গবেষণা করা (মানে, যথাসম্ভব জানার চেষ্টা করা ঐ বিষয়ে) শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট, কোর্স কারিকুলাম, ইত্যাদির পেছনে সময় দেন। এই প্রক্রিয়াটা যতো আনন্দদায়ক হবে, আপনার মোটিভেশন লেটারটাও ততো বেশি জেনুইন এবং ফলপ্রসূ হবে।
ফোকাস ঠিক রাখেন। নিজের প্যাশনের নার্চার করেন। প্যাশন নাই এমন কিছুর পিছে যদি সময় না দেন, এবং শুধু প্যাশন অনুযায়ীই ফোকাস ঠিক করেন, তাইলে মোটিভেশন লেটারটা জোর করে লেখা লাগবেনা। এমনি এমনি বের হয়ে আসবে। সুতরাং, বি জেনুইন।
৬। এপ্লাই করার সময় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, বয়স, র্যাংকিং এইগুলা দেইখা ঘাবড়াইয়েন না। আপনার পছন্দের সাবজেক্ট যদি দুনিয়ার সবচাইতে টপ র্যাংকড বিশ্ববিদ্যাগুলাতেই ভাল পড়ায়, এবং আপনার ঐ পছন্দের সাবজেক্টের সাথে যদি আপনার জ্ঞান, মেধা, প্যাশন ইত্যাদি ম্যাচ করে, তাইলে ঐটাই আপনার বিশ্ববিদ্যালয়। এমন হইতে পারে যে, আপনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইলেন না, কিন্তু সেকন্ড বেস্ট কোথাও পাইলেন। সেইটাও অনেক ভাল ব্যাপার হবে।
৭। নেতিবাচক বন্ধুদের সাথে সথাসম্ভব কম চলুন। বাংলাদেশে আপনার আশেপাশের বন্ধুদের একটা বড় অংশই জীবনে আপনার একটাও প্রশংসা করবেনা। কিন্তু সুযোগ পাইলেই নানান নেতিবাচক কথা বলে আপনার কনফিডেন্স ভেঙে দিতে চাইবে।
তার মানে বলছি না যে খালি তাদের সাথেই চলুন, যারা খালি আপনার প্রশংসাই করবে। চলুন তাদের সাথে, যারা প্রজ্ঞাবান। যারা আপনার সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা, দুইটা নিয়েই সৎভাবে আপনাকে পরামর্শ দেবে।
আমি যখন আবার পড়ালেখায় ফেরার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম, তখন একদিন এটিএম গোলাম কিবরিয়ার সাথে আলাপ করতাছিলাম। কিবরিয়া তখন অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স করতাছিল। সে আমাকে বললো দুনিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে এপ্লাই করা শুরু করতে। তো, এই টাইপের পরামর্শগুলা আসলে খুব উপকারী।
আপনার নিজের কনফিডেন্স বেশি থাকলেও দরকারী। আর আমার আরেকজন বন্ধু, ফাহিমা দূররাত, তাকে এই ব্যাপারে ধন্যবাদ দিলেও ছোট করা হবে। বলা যায় একাডেমিক পড়াশোনার লক্ষ্য, কনফিডেন্স ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রেই আমার উপর তার বিশ্বাসটা বড় ধরনের প্রণোদনা হিসাবে কাজ করছিল ঐ সময়।
তো, বন্ধু ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা মাথায় রাখবেন। ঐ বন্ধুদের সাথেই বেশি চলুন, যারা আপনার স্বপ্নটাকে ধারণ করতে পারে। বা অন্তত সম্মান করতে পারে। তাদের সাথে কম চলুন, যারা আপনার স্বপ্নকে খুন করে ফেলবে।
অবশ্য বাংলাদেশের সমাজে আমাদের এমন অনেক নেতিবাচক বন্ধু থাকবেনই, কিছু করারও নাই। তাদেরকে আদর করুন। তবে মাথায় উঠতে দিয়েন না। দ্যাটস অল।
৮। সবশেষে, যদিও না বললেও চলতো, তাও বলে রাখি। এডমিশন থেকে শুরু করে অন্যান্য সবকিছুর পেছনে নিজে সময় দেন। কোন তথাকথিত এডমিশন এজেন্সির কাছে যাইয়েন না। সিনিয়র ভাই বোন যারা দেশের বাইরে পড়াশোনা করছেন আপনার পছন্দের বিষয়ে, তাদের সাথে প্রয়োজনে আলাপ করতে পারেন।
কিন্তু, আপনার নিজের লেগে থাকা ও নিজের মতো সবকিছু জানার চেষ্টা করাটাই সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি এইসব ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল না হইতে পারেন, বা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মতো কনফিডেন্ট না হইতে পারেন, তাইলে আসলে উপরের কোন পরামর্শই আপনার জন্যে নয়।
ছবিঃ ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের সাথে। তখন এই বিষয়ের উপরে একটা মাইনর করতাছিলাম। সময়কালঃ ২০১৯।
– পারভেজ আলম