ইলন মাস্ক টুইটার কিনছেন। সব মিলিয়ে দাম পড়ছে ৫৩ বিলিয়ন ডলার। প্রথমে ৯ বিলিয়ন দিয়ে একক সর্বোচ্চ শেয়ারহোল্ডার হন, এরপর ৪৪ বিলিয়ন দিয়ে বাকীটা কিনতে যাচ্ছেন।
ইলন মাস্ক কোন কাঁচা ব্যবসায়ী না, বিশাল টিম নিয়ে যাচাই বাছাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নেন না। তিনি নিজের হিসাব নিজে করেন, অনেকটা টিম কুকের মতো।
তবে এ্যাপেলের টিম কুক যেমন বলতেন আমি ভালো প্রোডাক্ট বানাবো, কাস্টমাররা সেটা কেন কিনবে না, মাস্ক তেমন না। তিনি বিভিন্ন ব্যবসায় আছেন, প্রায় সবই ভালো করছে।
মার্কেটে বা কাস্টমারদের মধ্যে কিসের চাহিদা আছে বা আসবে সেভাবেই তিনি কাজ করেন। ২৩ বছর আগে এক্সডটকম দিয়ে যেই টাকা পয়সা লেনদেনের ব্যবসা শুরু করেন, তখন মানুষ ক্রেডিটকার্ডকেই সবচেয়ে প্রগতিশীলতা মনে করতো। তার এক্সডটকম পরে বদলে পেপ্যাল হয়। মানুষ মেইলআইডি দিয়ে কিভাবে টাকা আনা নেয়া করে, সেটাও মাস্কের শুরু। তখনও মোবাইল মানি ট্রান্সফার শুরু হয় নাই। পেপ্যালে উনি নাই, কিন্তু পেপ্যালের নেট লাভ এখন বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশী, অনেক কোম্পানী ৪ বিলিয়ন ডলারও সারা বছর বেঁচতে পারে না।
যখন স্পেসএক্স শুরু করেন, কেউই চিন্তা করেনাই রকেট বা স্যাটেলাইট পাঠাতে কেউ এমন কাজ করবে। তিনি আরেক ডিগ্রি বাড়িয়ে সেটাকে রকেট লন্চ করে যেনো লন্চার আবার ফেরত আসে এবং তা পানিতে জাহাজে নামে সেই বিদ্যা দেখালেন। উনি বড়লোকদের মতো ডোনেশন করে বেড়ান নাই, বই লিখে চলেন নাই, বিশাল ইয়ট কেনেন নাই, দামী পেইন্টিং কেনেন নাই, নূতন কোম্পানি কিনে সেটাতে ব্যর্থ হন নাই, স্পেস ভ্রমন করতে যান নাই। তিনি আইডিয়া এনেছেন, সেটা ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগিয়েছেন।
যেমন ধরেন ব্যাটারিচালিত টেসলা গাড়ী। টেসলা নাম নেয়া নিকোলো টেসলা থেকে যিনি টমাস এডিসনের ডিসি বিদ্যুৎএর বদলে সবসময় এসি বিদ্যুৎকেই প্রাধান্য দিতেন, সেই টেসলার নামে গাড়ী বানিয়ে ডিসি বিদ্যুৎ দিয়ে চালিয়েছেন। বর্তমানে টেসলার অর্ডার নিতে গিয়ে দেখা গেছে ১০০ ডলার বুকিং দিয়ে গাড়ীর যে অর্ডার হাতে আছে, নূতন প্লান্ট না হলে সেটা শেষ করতেই ৮-১০ বছর লাগবে। ইলন মাস্ক মানেই ব্যবসা।
লসএন্জেলেসে এবং লাসভেগাসে দুটো প্রজেক্ট শেষ করেছেন তার বোরিং কোম্পানি দিয়ে। নামের বানান বোরিং, তবে কাজ হলো মাটির নীচে বোর করা, অর্থাৎ টানেল বানানো। কতোজন আছে এক কোম্পানি খুলে এই টানেলের কাজ একা করতে যাবে? ইলন মাস্ক করেছেন। এখন যেটা টপিক, সেটা হলো উনি টুইটার কিনছেন। যেহেতু মাস্ক আজকের কথা চিন্তা করে কাজ করেন না, উনার হিসাব আছে এটাকে দিয়ে কি কাজ করাবেন।
আরো পড়ুন
মিটিং আর পাওয়ার পয়েন্ট থেকে দূরে থাকুন, কর্মীদের সাথে থাকুন : ইলন মাস্ক
কোম্পানি কেনাবেচায় লাভ-লোকসান হয়। এটা ব্যবসার নিয়ম। এটাতো আর আজ থেকে হচ্ছে না। সবার উদ্দেশ্য এক না।
উদাহরন দেই। যেমন আইবিএম কিনলো লোটাসকে, প্রোডাক্ট ভালো হলেও মার্কেটিংএ ভালো করতে পারেনি। নোটস বা ডোমিনোর মতো এতো ভালো একটা সফ্টওয়ারকে দাঁড় করাতে পারলো না। বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য ১৮ হাজার নোটসের ইউজার লাইসেন্স কেনা আছে, কিন্তু তারা এখনো জিমেইল, ইয়াহু, হটমেইল ব্যবহার করে।
ইয়াহুর কাছে বিক্রি হবার অনেক চেষ্টা করেছে জিমেইল, পারলোই না। এখন সেই গুগুলের হাতে ইউটিউবের মতো রাজহাঁস আছে। ডেটামাইনিং খনি আছে। মাইক্রোসফ্ট কিনলো নোকিয়াকে, এরপর ছেড়ে দে মা বলে বেঁচেও দিয়েছে। আবার ইএমসিকে নিয়ে ডেল আরো শক্ত হয়েছে।
এ্যালেক্সার মতো এতো ভালো একটা কোম্পানি আমাজান কিনে চালাতে পারলো না, ১লা মে ২০২২ এটা পুরো বন্ধ হয়ে যাবে। আবার দেখেন ফেইসবুক পরপর হোয়াটসএ্যপ আর ইন্সটাগ্রাম কিনে লাভ বের করে নিচ্ছে। প্রফেশনালদের নেটওয়ার্ক লিংকডইনকে কিনে মাইক্রোসফ্ট এটাকে লাভজনক বানাতে পেরেছে।
কেনাবেচায় রিস্ক থাকে, কোনটা ভালো হবে বা খারাপ, আগে থেকে বোঝা যায় না। প্রশ্ন হলো টুইটার কিনে কি ইলন মাস্ক ভুল করলেন না ঠিক করলেন? কিনে এটা দিয়ে কিভাবে কাজ করাবেন? বিজনেস মডেল কি হবে? এটাই শুধু মনে রাখি, মাস্ক বলেছিলেন টুইটারের বিশাল প্রসপেক্ট, অনেকেই তা দেখতে পারছে না, কিন্তু উনি জানেন একে কতো বড় করা যায়।
যাই বলবো পুরোটাই ধারনা থেকে, অনেকটা নিজের মতো বানানো। তবে কোন গুজব বানানো আমার উদ্দেশ্য না। এটা ১৫০০ সাল না যে ভবিষ্যতবানী করা যাবে না।
আমার ধারনা, টুইটার কেনার সময়টা খেয়াল করলে কিছু বোঝা যাবে। সামনে ইউএসএ এর কিছু হাউস অফ রিপেরেজেন্টেটিভ ইলেকশন আছে, রিপাবলিকানরা কিছু পিছিয়ে। অন্যদিকে ডনাল্ড ট্রাম্প টুইটারে নিষিদ্ধ, নিজের একটা টুইটার চালু করে একদিনও চালাতে পারেন নাই। শুরুতেই এই ট্রুথ এর টেকনোলজিকালি দুর্বলতা ছিলো।
টুইটার দিয়ে ইলন মাস্ক একদিকে রিপাবলিকানদের এবারের ভোটে জয় আনার আর ২০২৪ এ প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে ভূমিকা রাখতে পারে, অথবা সম্পূর্ন উল্টো কাজ করে ডেমোক্রেটদের জন্য কাজ করতে পারে।
টুইটারের বিশাল বেইজ, সেটা জনমতে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে জনপ্রিয় নয় কারন সময় পেলে আমরা ইউটিউবে নাটক সিনেমা দেখি। না হলে বিশ্বের বেশীরভাগ নেতারাই টুইটার ব্যবহার করে। সেলিব্রিটিরাও করে, সাধারন মানুষ করে। অল্প কথায় নিজের চিন্তা বোঝানোর জন্য টুইটারের বিকল্প নাই।
টুইটার সম্ভবত এইমূহুর্তে সবচেয়ে ইনফ্লুয়েনসিয়াল টুল। ফেইসবুকের মতো বিভিন্ন ফ্লেভার নিয়ে বসে নাই। রিপাবলিকানরা এরমধ্যে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে ডনাল্ড ট্রাম্পের উপর ব্যান তুলে নিতে। আর ইলন মাস্ক বলেছেন তিনি ফ্রি স্পীচ বা মুক্ত বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চান, তিনি চান তার সবচেয়ে বড় সমালোচকরাও যেনো টুইটারে আসে এবং লিখে, যা তাদের বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।
আমার দ্বিতীয় একটা ধারনা আছে, যেহেতু অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম, টুইটারের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করা সম্ভব। এই ধরনের কোম্পানিগুলো কিছুটা দায়বদ্ধ বিভিন্ন সরকারের কাছে, যেমন ভারতের কৃষক বিপ্লবের সময় তাদের সরকারী সামরিক ইন্টেলিজেন্স অনেক সাংবাদিক, সিভিল সোসাইটির সদস্য এবং মানবাধিকার কর্মীদের টুইটার একাউন্ট বন্ধ করতে বলেছে, এবং টুইটার করেওছে।
পরে সমালোচনার মুখে খুলেও দিয়েছে, কিন্তু যখন ব্যাক্তি মালিকানায় থাকবে তখন এতোটা কঠোর করানো যে কারো জন্য সম্ভব না। তেমনি চাইলে মাস্কের টুইটার পুরোই উল্টা কাজ করে বসতে পারে যেটাতে সেই সরকার বিপদে পরে।
তৃতীয় ধারনা হলো, টুইটারে বিজ্ঞাপন অনেক কম, যা ফেইসবুক আর ইউটিউব করছে। এখানে একটা সাবসক্রিপশন মডেল সাথে বিজ্ঞাপন মডেল দাঁড় করাতে পারে। প্রিমিয়াম সার্ভিসের জন্য প্রিমিয়াম নিতে পারে যেমন লিংকডইন করে।
চতুর্থ ধারনা অবশ্য ইলন মাস্কের সাথে যায় না। তিনি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করেন না বা কাউকে অনুসরন করেন না। যদি করেন, তাহলে ফেইসবুকের মডেল কিছুটা নিতে পারেন, বাকীটা লিংকডইনের। যেমন ফেইসবুকে আপনি নিজস্ব প্রোফাইল তৈরী করবেন, আবার নিজস্ব পেইজ তৈরী করবেন।
লিংকডইন শুধু সদস্যদের জন্য চার্জ করেনা, তবে প্রিমিয়াম সদস্যদের জন্য করে। টুইটার একই কাজ করতে পারে, একটা সার্বজনীন টুইট যা সবাই লিখতে ও দেখতে পারবে, সাথে আরেকটা প্রিমিয়াম আইডি যেটা খুলতে পয়সা লাগবে, আর যিনি একাউন্ট খুলবেন তার অনুমতি ছাড়া অন্যরা পড়তে পারবে না, অনেকটা ফেইসবুকের ফ্রেন্ডস অনলি ধরনের মোড।
পন্চম ধারনা চতুর্থের মতন, তবে এই দ্বিতীয় আইডি থেকে যা লেখা হবে সো কল্ড ফ্রি স্পীচ, তা নির্দিষ্ট ফ্রেন্ডগ্রুপের কাছে পৌছে যাবে। যেমন ইইউ নেতারা একটা গ্রুপ করলেন, বাইরের কারো জানার সুযোগ নাই। অথবা কোন পার্লামেন্টের সব মেম্বারদের জন্য গ্রুপ, অনেকটা হোয়াটসএ্যাপের মতো বিজনেস গ্রুপ তৈরী করা।
আরো ধারনা করতে পারেন যা হয়তো ইলন মাস্কের মাথায় আছে, আমরা সেই পর্যন্ত পৌঁছাই নাই। তবে তিনি সম্ভবত আমাজনের মতো এলেক্সা খুন করতে যাবেন না।
ঠিক যেমন ভাবে কমপ্যাক কোম্পানি ডিজিটালকে কিনেছিলো বন্ধ করতে, তখনও জানেনি একবছর পর এইচপি সেই কমপ্যাককে কিনবে বন্ধ করার জন্য, আবার মাইক্রোসফটও তিনটা কোম্পানি কিনে এক করে নূতন ব্যবসা করেছে ও সফল হয়েছে। আবার স্নাপচ্যাট কিনবার জন্য অফার দিলেও তারা বিক্রি করছে না।
টেকনোলজির বাজারে সব কিছু সম্ভব। ইলন মাস্ককেও ভিশনারী ব্যবসায়ী থেকে ধূর্ত শেয়াল বা হায়েনা বানানো সম্ভব।
– Quazi M Murshed