ভারতীয় বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের নামে মুখরোচক গল্পটি একটি মিথ হয়ে গত কয়েক বছর ধরে ফেসবুকে বেশ গরম সমুচার মতো স্বাদ বিতরণ করে চলছে।

বলা হচ্ছে জাপানের বাংলাদেশের প্রতি এত সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের পেছনে একটি লোক জড়িত। তিনি হলেন ড. রাধাবিনোদ পাল নামের একজন ব্যক্তি।

তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জাপান বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত সবসময় বাড়িয়ে দিয়েছে।
এটা একটি অতিরঞ্জিত ব্যাপার বটে।

আমরা জাতিগত ভাবে আবেগপ্রবণ জাতি। ইনিয়ে বিনিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প বানিয়ে তা থেকে আবেগ নিংড়ে বের করাতে সিদ্ধহস্ত। এটা তারই উদাহরণ। কথাটি হজম করা কঠিন কিন্তু সত্য।

বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফারইস্ট এর “টোকিও ট্রায়াল” নামক বিচারকার্যের প্যানেলের ১১ জনের একজন বিচারপতি ছিলেন।

অবশ্যই সে সময়ে সেখানে তিনি ভারতীয় হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন।

This trial, by the International Military Tribunal for the Far East (IMTFE), would come to be known as the “Tokyo Trial”.

It was felt that the bench should be adorned by justices from all the countries that had felt the heat from expansionist Japan – Russia, China, Philippines, Australia, Indonesia, New Zealand and India!

জানা যায় যে রাধাবিনোদ পালকে মূলতঃ একজন বিচারক প্রতিনিধি হিসেবে এশিয়া থেকে নামকাওয়াস্তে নেয়া হয়।

এটাও পরে আবিষ্কৃত হয় যে তাকে যে হোটেল দেয়া হয় তা অন্যান্য হোটেল থেকে নিম্নমানের ছিল। অর্থাৎ তার মতামতের চেয়ে তার উপস্থিতি দেখানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কিন্তু পাল প্রমাণ করলেন যে তিনি সেখানে পুতুলের মতো পূর্বনির্ধারিত রায় পালন করার লোক নন।
সেখানে জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তুজোসহ ২৪ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলছিল।

সেখানে সব বিচারক তাদের গিল্টি বলে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। একমাত্র “not guilty” বলেছিলেন রাধাবিনোদ পাল।

He gave a number of arguments terming the Tokyo War Trials as irregular and illegal.

Justice Pal’s dissenting opinion was severely criticised all over the western countries.

Pal’s view was “aggressive war was reasonable because it is about National Sovereignty”.

He pointed out that the Western countries acquired their Colonies by brutal wars and hence did not have a moral right to stand in judgement.

He was of the opinion that conquerors should not pass judgement on the conquered and the Tokyo trials were more of a victor’s revenge.

In his judgement, Pal was very severe towards Japan too, but his criticism of the US was very serious.

তিনি বলতে সাহস করেছিলেন যে জাপানিদের বিরুদ্ধে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয় তাহলে তার চেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপার ঘটেছে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ফেলার মধ্য দিয়ে।

তাঁর ১২৫০ পৃষ্ঠা ব্যাপী রায়ে তিনি বলেন যে যারা বিভিন্ন নারকীয় যুদ্ধের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশকে কলোনী করে রেখেছে তাদের পক্ষে সুবিচার করা মানায় না।

বিজয়ী পক্ষ কোনদিন পরাজিতদের উপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। একটা যুদ্ধের যে পক্ষই হোক না কেন উভয়পক্ষই যুদ্ধের জন্য দায়ী।

বলা বাহুল্য, পশ্চিমা বিশ্ব পালের এই রায় মেনে নিতে পারে নাই এবং রায়টি ছাপাতে অস্বীকৃতি জানালো।

রাধাবিনোদ তাঁর রায়ে জাপানের প্রতি কঠিন হয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

পালের রায় যদিও খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারে নাই কিন্তু তাঁর জাপানের প্রতি নমনীয়তা এবং পশ্চিমাদের একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় মনোভাব জাপানে চরমভাবে আদৃত হলো।

জাপানিরা তৃতীয় বিশ্বের এই লোকটির দৃঢ়তা দেখে চমৎকৃত হলো এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হলো।

জাপান সরকার রাধাবিনোদ পালের এই ভূমিকার কথা ভুলে নাই।

১৯৬৬ সালে তাঁকে জাপানের সর্বোচ্চ সম্মান “Order of the Sacred Treasure” দিয়ে তাকে ভূষিত করা হয়।

তাঁর মৃত্যুর পর জাপান তাদের জাতীয় বীরদের সম্মানে যে মেমোরিয়াল আছে সেই “YASUKUNI SHRINE” এ রাধাবিনোদ পালের নামে একটি মনুমেন্ট তৈরি করে।

আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে রাধাবিনোদকে কেউ বাঙালি বলে চেনার অবকাশ ছিল না। রাধাবিনোদ সেখানে ইন্ডিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

জাপানও তাকে চিনে একজন ভারতীয় হিসেবে এবং তিনি একজন ভারতীয় হিসেবে কলকাতার বিভিন্ন উচ্চপদে যেমনঃ হাইকোর্টের বিচারপতি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে কাজ করে গেছেন।

জাপান সরকারের প্রধানমন্ত্রী জুনিচুরো কৈজুমি যখন ২০০৫ সালে দিল্লি সফরে আসেন তখন দিল্লিতে তাঁর সম্মানে দেয়া ভোজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পেছনে রাধাবিনোদ পালের অবদানের কথা স্মরণ করেন এবং বলেন,

“It is a noteworthy fact that though we have gone through various phases in our relationship, in times of difficulty, we have stood by each other.

….. The dissenting judgement of Judge Radhabinod Pal is well-known to the Japanese people and will always symbolise the affection and regard our people have for your country”.

২০০৭ সালে অপর জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো

এবে ভারত সফরে যান এবং কলকাতায় পালের ছেলে শ্রী প্রশান্তের সাথে দেখা করে তার পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

“Justice Pal is highly respected even today by many Japanese for the noble spirit of courage he exhibited during the International Military Tribunal for the Far East,” Mr. Abe told the Indian Parliament.

তবে এখানে বলা প্রয়োজন যে জওহরলাল নেহরু রাধাবিনোদ পালের এই রায়ের সাথে ভারতের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন এবং বলেন যে পাল ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কর্তৃক মনোনীত।

জওহরলাল নেহরু বলেন :
“In this judgment wild and sweeping statements have been made with many of which we do not agree at all.

In view of suspicion that the Government of India had inspired Pal’s judgement, we have had to inform Governments concerned informally that we are in no way responsible for it.”

আরো বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল যে পুরানো নথি খুঁজে পাওয়া গেছে যে রাধাবিনোদ পালের বিচারক হিসেবে অনুমোদন দিয়েছিল তৎকালীন India’s War Department.

এর তিনদিন পর তৎকালীন গভর্নর জেনারেল এই নিয়োগের বিরোধিতা করে নোট পাঠিয়েছিল এবং এতে war dept এর সেক্রেটারি গভর্নর জেনারেলের অফিসে এপলজি লেটার পাঠিয়েছিল এই ভুলের জন্য।

war dept রাধাবিনোদ পালের ব্যাকগ্রাউন্ড না তলিয়ে অন্যান্য কোন কোন বিভাগের পরামর্শ ব্যতিরেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কারণ পরবর্তীতে প্রকাশ পায় যে রাধাবিনোদ পালের সাথে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের ও হিন্দু মহাসভার একটি যোগসূত্র ছিল।

রাধাবিনোদ পাল

রাধাবিনোদ পাল

(প্রফেসর নাকাজাটো এর রিসার্চ) যদি ব্রিটিশরা জানতো যে তাঁর এই যোগসূত্র তাহলে হয়তো তাঁকে আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল বিচারক হিসেবে পাঠানো হতো না।

কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার রাধাবিনোদ পালকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার “পদ্মভূষণ” উপাধিতে ভূষিত করেন।

কলকাতা শহরের মধ্যস্থলে তার সম্মানে এক মূর্তি স্থাপন করা হয়।

সুতরাং এটা মনে করে আত্মপ্রসাদে জাবর কাটার প্রয়োজন নেই যে রাধাবিনোদ পালের কথা মনে করে জাপান বাংলাদেশের প্রতি দুর্বল।

সেটা হলে তাদের ভারতের প্রতি বা পশ্চিমবঙ্গের প্রতি দুর্বলতা থাকতে পারে। বাংলাদেশের সাথে জাপানের সখ্যতা স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে।

এর পেছনে ড. রাধাবিনোদ কোন ইস্যু নয়। আর সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো যে প্রায়ই একটা কথা বলা হয় যে জাপানের সম্রাট নাকি বলেছেন যে জাপান থাকতে কোন বাঙালি না খেয়ে মরবে না!!

Japanese emperor Hirohito said, “As long as there will be in Japan, Bengali food shortage and the financial problem will be overseen.

Japan will be a selfless friend forever to Bangladesh.”

এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না ? এরকম উক্তি তিনি কখনই করেন নি। এটা হলো অতি আবেগীয় একটি কথা। যিনি ১৯৬৭ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি বাংলাদেশি কিভাবে হন ?

আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে শুধুমাত্র একটি লেখা পেয়েছি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত incap নামক পেজে যেখানে এই গল্পটি ফাঁদা হয়েছে আর তারই বাংলা অনুবাদ করে চর্বিতচর্বন চলছে আর যার ইচ্ছে সে কোনরকম চিন্তা না করেই শেয়ার করছে।

জাপানি সম্রাট এ কথা মোটেই বলেন নাই। বারবার বলছি বহির্বিশ্বের কাছে রাধাবিনোদ পাল বাঙালি নয় ভারতীয় হিসেবে পরিচিত।

রাধাবিনোদ পাল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজত্বের সময় তৎকালীন পূর্ব বঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাতে আমরা বলতে পারি যে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু সেই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের আজকের প্রখ্যাত সিংহভাগ কবি, লেখক, সাহিত্যিক, প্রফেসর, ব্যারিস্টার বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

তাতে আমরা তাদের অবদানকে নিজেদের বলে দাবি করতে পারি না। তবে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করতে পারি।

বাংলাদেশে রাধাবিনোদ পালের অবদানের কথা কোনোভাবেই স্বীকার করা হয় নি বা তাঁর সম্মানে কোনরকম স্বীকৃতি দেয়া হয় নি।

এটা কি বিস্ময়কর নয় যে যদি রাধাবিনোদ পালের কথা মনে করেই জাপান বাংলাদেশের প্রতি দুর্বল থাকতো তাহলে রাধাবিনোদ পালকে বাংলাদেশ সরকারের মাথায় তুলে রাখার কথা আর জাপানি প্রধানমন্ত্রীর কলকাতায় না গিয়ে বাংলাদেশে এসে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার কথা।

কিন্তু এরকম কিছু ঘটে নাই কারণ এটা সত্য নয়। নির্জলা মিথ্যে।

তবে বাংলাদেশে রাধাবিনোদের গ্রামের বাড়িতে একটি জাপানি টিম এসেছিল তাঁর উপর একটি জীবনী ধরণের ডকুমেন্টারি তৈরি করার জন্য।

স্থানীয় লোকজনের জন্য তা হয়ে উঠে না। এক স্থানীয় প্রভাবশালী লোক তার জায়গা আত্মসাৎ করে রাখায় সেখানে জাপানি সরকারের একটি স্কুল করার প্রস্তাবও বাতিল হয়ে গেছে।

যে ব্যাপারে বিস্তারিত ইন্টারনেট খুঁজলে পাবেন। ইন্টারনেটের এত তথ্যাদি থাকা সত্ত্বেও কেন এগুলো সম্পর্কে লোকজনেরা পড়াশুনা করে না তা বুঝি না।

Writer: MD Khan