“আমি মনে হয় বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি যে, পিএইচডি অফার হাতে নিয়ে নিয়ে ক্যারি/ব্যাকলগ পরীক্ষা দেই।”

আমি যখন আহসানুল্লাহ-তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম, আমার বাবা-মা সবসময় বলতেন, “বাবা, তুমি কোনোমতে পাশ করতে পারলেই খুশি, কারণ আমরা জানি ইঞ্জিনিয়ারিং অনেক কঠিন”।

আমি যত ক্লিয়ারেন্স/ক্যারি (ব্যাকলগ) দিতাম সব আমার মা জানতেন। ইভেন তারা জিজ্ঞাস না করলেও আমি আমার সিজিপিএ বলতাম।

আমার বাবা-মা এতেই খুশি থাকতো, কারণ আমি পাশ করে এক সেমিস্টার থেকে আরেক সেমিস্টারে উঠি।

“এত কম সিজিপিএ কেনো পেয়েছো?”, “কেনো ক্লিয়ারেন্স খেয়েছো?” এগুলা কখনো জিজ্ঞেস করতেন না (যদিও ২.১~৪.২ পর্যন্ত কোনো ক্লিয়ারেন্স খাইনি)।

শুধু এটা বলতো, “বাবা ক্লিয়ারেন্সে পাশ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আমরা জানি বিষয়টা কঠিন”।

শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফ না, স্কুল-কলেজ লাইফেও আমাকে কখনই অমুক-তমুকের সাথে তুলনা দেন নাই আমার মা-বাবা। আমি বরাবরই এভারেজ ছাত্র ছিলাম।

তবে ক্লাস-টু-ক্লাস পাশ করে ফেলতাম। ফলে জীবনেও একাডেমিক গ্যাপের সম্মুখীন হতে হয় নাই। স্কুলের ভালো ছাত্রদের আমার আম্মা খুব আদর করতেন, কিন্তু আমাকে কখনই প্রেশার দিতেন না আমি কেনো ওদের মতো ভালো করি না।

এইচএসসিতে আমার রেজাল্ট সামান্য একটু এদিক সেদিক হয়। আমি ভাবলাম আমার বাবা-মা কষ্ট পাবেন। উলটা রেজাল্টের দিন তারা আমাকে সান্ত্বনা দিলো “বাবা তুমি অনেক ভালো করেছো, আমরা অনেক খুশি”।

জীবনেও বুঝতে দেন নাই তারা আপসেট ফিল করেছেন। এটা কোনোদিনই বলেননি, “গোল্ডেনটা মিস হলো কেনো?”।

আমি বিশ্বাস করি, সেদিন ফেল করে আসলেও আমাকে তারা অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যেতেন।

তারপর, আহসানুল্লাহ লাইফের ৪র্থ বর্ষের শুরুর দিকে ব্যাচের সবার আগে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র হয়েও কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি অফার পাই।

তখন মাত্র ২.৭৬/৪.০০ সিজিপিএ সাথে ২ টা ব্যাকলগ ওয়ালা ব্যাকব্যাঞ্চার আমি। কোরিয়াসহ মোট ৬ টি ফুল-ফান্ডেড পিএইচডি ও মাস্টার্স অফার পাই এই রেজাল্ট নিয়ে।

তাও চতুর্থ বর্ষে, গ্রাজুয়েশন এর অনেক আগে। অবিশ্বাস্য হলেও, কঠোর পরিশ্রম, প্রবল ইচ্ছার কারণে আমি সকল ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে এসব কিছু অর্জন করি।

আমি মনে হয় বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি যে, পিএইচডি অফার হাতে নিয়ে নিয়ে ক্যারি/ব্যাকলগ পরীক্ষা দেই।

এবার আসা যাক, কতটা বিপর্যস্ত ছিলো আমার ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফ। এমন অনেক দিন ছিলো, আমি ল্যাব ভাইবাতে পুরো সেকশনে একাই শূন্য পেয়েছি।

বাকি সবাই মোটামুটি ভালো করেছে। স্যাররা ভাইভাতে প্রশ্ন করতেন আর আমি হা করে তাকিয়ে থাকতাম। “এভাবে কি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ হবে?”, প্রায় সময়ই এই কথা শুনতাম।

অগনিত ল্যাব সেটআপ পরীক্ষায় কোনো সমাধানই করে আসতে পারি নাই। ৩য় বর্ষের ম্যাটল্যাবের কোর্সে পুরো ব্যাচের মধ্যে লোয়েস্ট গ্রেড (D) (৪৩/১০০) নিয়ে পাশ করা লোকটা আমি।

আমার ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফের এমন এক সেমিস্টার ছিলো যেখানে আমি ২.৩৭/৪.০০ সিজি নিয়ে ড্রপ খাওয়া বাচাঁই। আহসানুল্লাহ লাইফে বেশিরভাগ কুইজ পরীক্ষায়ই ধরা খেতাম।

কুইজে অর্ধেক নাম্বার পাওয়া আমার কাছে ভালো কুইজ হিসেবে গন্য হতো। জীবনের এমন অনেক সেমিস্টার ফাইনাল ছিলো যেখানে ব্যাচমেটদের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনায়, আমার তাকায় থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা।

আমি আমার সর্বশেষ ব্যাকলগ পরীক্ষা দেই ৪.২ এর লাস্টে।

তবে এতকিছুর পড়েও মন খারাপ করি নি। হতাশা আমার গ্রাস করতে “চাইতো”, তবে এই হতাশাকে কখনই আমার কাছে আসতে দেইনি। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম আমি পারবো।

ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফে আমি যতটা না খারাপ ছাত্র ছিলাম, ঠিক ততটাই টেকনিক্যালি ভালো হওয়ার চেষ্টা করতাম।

আমি জানতাম যেহেতু একাডেমিক্যালি আমার ভালো হচ্ছেনা, তাই আমাকে একজন ভালো টেকনিক্যালি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। এই লক্ষ্যে আস্তে আস্তে কাজ করা শুরু করি।

সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে এক স্বনামধন্য কোম্পানিতে নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং দলের সাথে কাজের সুযোগ পাই।

সেখানে প্রায় ৭ মাস কাজ করে বুঝতে পারি, এখানে থাকলে তেমন অগ্রগতি সম্ভব না। তবে সেখানে কাজ করতে থাকলে, পাশ করার পর চাকরি নিয়ে কোনো চিন্তা ছিলো না।

কিন্তু আমি রিস্ক নিলাম। চাকরিতে রিজাইন করলাম। ওই রিস্কটাই আমার জীবনের বেস্ট ডিসিশানের একটা।

কারণ আমার সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই পিএইচডি করবো এই ইচ্ছা। তাই তৃতীয় বর্ষের শুরু থেকেই আস্তে আস্তে মেশিন লার্নিং নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলাম।

চাকরি ছেড়ে দিয়েই আমার ক্যারিয়ার নিয়ে প্লানিং শুরু করলাম, তখন এটা মাথায় রেখেছিলাম, আমার সিজিপিএ কত আর কিভাবে নিজেকে স্কিল্ড হতে হবে।

কোনো কিছু শেখাটা ও লং টার্ম ধৈর্য ধরে রাখাটা অনেক ডিফিকাল্ট। কিন্তু আমাকে পারতেই হবে যেভাবেই হোক। চাকরিতে থাকা অবস্থায় টুক টাক করে পাইথন শিখলাম।

সেটা মেশিন লার্নিং এর প্রাণ বলা যায়। তারপর প্রথম পাবলিকেশন, তাও খুব সাধারণমানের এক জার্নালে। এরপর একটা ভালো কনফারেন্সে পেপার পাবলিশ হলো, এভাবে আমি একাধিক পাবলিকেশন এর মালিক।

সবগুলাই সিংগেল অথোর। ৪র্থ ইয়ারের শুরুতেই জিয়ারি আর টোফেল দেই, হাতে স্কোর, পাবলিকেশন ও ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স মিলিয়ে দেখলাম সিজিপিএ বাদেও আমার প্রোফাইল একবারে খারাপ না।

মেইল করা শুরু করলাম প্রফেসরদের। তখন লকডাউন চলে, আমি ফোর্থ ইয়ারে উঠলাম মাত্র।

একাধিক প্রফেসর ইন্টারভিউ নিলেন, এর পাশাপাশি পিএইচডি অফার করলেন। ইন্টারভিউর একটা পর্যায়েও আমার সিজিপিএ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন নাই কেউ।

আমার এই যাত্রায় কোনো ফ্রেন্ড ছিলোনা, বড় ভাই গাইড করার ছিলো না। টিচার ছিলোনা। একাধিক ফ্রেন্ডকে আমি আমার সাথে কাজ করতে বলি, কিন্তু কারোরই তেমন সাড়া শব্দ পাই নাই।

তাই নিজে নিজে সব করি। তাই এখানে আসা পেছনে মা-বাবা বাদে কারো ক্রেডিটও নাই।

প্লান অনুযায়ী, ৩য় বর্ষের শুরু থেকে ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত ভয়াবহ পরিশ্রম করলাম। নিজে যা বুঝতাম তাই করতাম।

আমাকে একটা ছোট্ট ইনফো দেওয়ারও কেউ ছিলো না। খুব প্যারা লাগতো, তবে হাল ছাড়া যাবেনা। এই ১~২ বছরের সাধনা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিলো।

২.৭৬/৪.০০ সিজিপিএধারী কারো সরাসরি পিএইচডিতে হয়, এটা অনেকটা বিরল। যেখানে সবাই “নো” বলে দিয়েছিলো, সেখান থেকেই “ইয়েস” করে দিয়েছি সকল নো কে।

স্মরণ করছি আমার এক নন ডিপার্টমেন্টার বন্ধুকে, যিনি বিভিন্ন সময়ে আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।

তারপর পিএইচডি যখন শুরু করি, জীবনে প্রথম বারের মতো আমি নিজ বাসার গন্ডি থেকে বের হই। বাসার গন্ডি থেকে সরাসরি আরেক দেশ। একটা ওয়াইল্ড জার্নি।

কারণ গ্রাজুয়েশন এর আগ পর্যন্ত মা-বাবার আশ্রয়স্থলে ছিলাম।পিএইচডি শুরু করার পর বুঝলাম, লাইফ ভীষণ কঠিন। ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফ থেকে যোজন যোজন গুণ কঠিন।

গবেষণার প্রেশার, একাডেমিক কোর্সওয়ার্কের প্রেশার, সাথে পারসোনাল লাইফ। সবকিছু জানি আমাকে প্রতিদিন গ্রাস করতো।

এসময়েও বাবা-মা অশেষ অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এ বছরের শেষে, আমি স্যামসাং এর হেডকোয়ার্টার এ পিএইচডি গবেষণার জন্য যোগদান করছি ডিভাইস সলিউশান (Samsung DS) দলের সাথে।

মূলত ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার সম্মিলিত এক প্রজেক্টে গবেষণা করছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ও স্যামসাং এর যৌথ গবেষণা।

এক্সপ্লেইনেবল এআই-র মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টর প্রসেস ও ফেইলিউর এনালাইসিস নিয়ে পরবর্তী ৩ বছর গবেষণা করবো।

স্যামসাং এর পরবর্তীতে যত নতুন ডিভাইস আসবে সেখানে আমার গবেষণার কন্ট্রিবিউশান থাকবে।

বর্তমানে মেশিন লার্নিং ফিল্ডের কিছু নতুন এরিয়া ডোমেইন এডাপটেশন ও মেটা-লার্নিং এর কিছু প্রবলেম নিয়ে গবেষণা করছি।

সবকিছুর উর্দ্ধে, স্যামসাং এ যোগদান ও পিএইচডি গবেষণা আমার মা-বাবাকে উৎসর্গ করলাম।

কারণ জীবনের প্রত্যকটি ব্যর্থতার দিনে সেই ছোটবেলা থেকে এইবেলা পর্যন্ত অতুলনীয় এক অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।

আমি জানি ভবিষ্যতের যেকোনো ব্যর্থতার দিনেও তারা পাশে থাকবেন। হয়তবা মা-বাবা সেই ছোটবেলায় আমাকে এক্সপেকটেশনের বারে ঝুলিয়ে দিলে অনেক আগে হারিয়ে যেতাম। এতদূর আসা হতোনা। তাদের একমাত্র দোয়া, ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, সাহসে আজ এখানটায় আসা।

তারা হয়তবা আগেই জেনে গিয়েছিলেন, সকল ব্যর্থতা শেষে আমি ভবিষ্যতে একদিন ভালো করবো। এবং তাই হচ্ছে। আমিও তাদেরকে নিরাশ করিনি।

ব্যাচের সবার আগে পিএইচডি শুরু করি, সাথে স্যামসাং এর হেডকোয়ার্টার এও গবেষণার পদে যোগদান করছি। আমার জীবনে অনেক ইচ্ছে ছিলো, আমি বিশ্বসেরা কোম্পানির জন্য গবেষণা করবো।

এবং আমি তাই পারলাম, সেই ২.৭৬ সিজিপিএ-র আমি, শেষমেশ পেরেই ফেললাম।

আমি মনে করি “ভালোকিছু করবো” এই মানসিকতাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবনে। রেজাল্ট যেমনই হতো ছোটবেলা থেকেই আমার মাথায় ঘুরতো যে আমি ভালো করবো।

এখনকার ছেলেমেয়েরা একটু খারাপ রেজাল্ট হলেও খুব হতাশায় ভুগে। তবে এখান থেকে লড়াইটা শুরু হয়। একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি, ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্রদের একটা স্কিলসেটে মনোনিবেশ করতে হবে।

দিনশেষে গ্রাজুয়েশন এর পর ভালো প্লেটমেন্ট ম্যাটার করে। তুমি পৃথিবীর বেস্ট স্টুডেন্ট হয়েও যদি ভালো কিছু না করতে পারো, সোশাইটিতে তোমার নলেজের কন্ট্রিবিউশান না থাকে, তোমার রেজাল্ট এর কোনো ভ্যালু নাই।

সহজ হিসাব। ক্লাসের লাস্ট বয় হয়েও যদি ভালো প্লেটমেন্ট হয় ও ভালো কন্ট্রিবিউশান থাকে, দিনশেষে ওইটাই ম্যাটার করে।

মনে রাখতে হবে, রেজাল্ট যেমনই হোক, ব্যাকলগ যতগুলাই থাকুক, জীবনে যতগুলা ড্রপ থাকুক, তোমার জীবনে সুযোগ আছেই।

তোমার রেজাল্ট যতটুক, তোমার স্কিল যতটুক ওটা নিয়েই ক্যারিয়ার প্লান করতে হবে। ভালো রেজাল্ট মানেই জীবনে ভালো করবা, খারাপ রেজাল্ট মানেই জীবন শেষ এমন কিছুই না।

আমি জীবনেও ক্লাসে ফার্স্ট হইনি, ইভেন টপ প্লেস ও করিনি, তাও সবার থেকে ভালো করলাম।

কিভাবে? কারণ হেরে যাওয়ার জন্য কাউকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি।

আমার ইচ্ছা পিএইচডি-র পর বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করা। তার জন্যেই পিএইচডি করতে আসা।

এখানে গবেষণার একটা ভালো ট্রেনিং পাচ্ছি। আশা করি ভালোমানের একজন গবেষক হিসেবে এই জার্নি শেষ করতে পারবো।

Taki Hasan Rafi,
Graduate Researcher, Data Intelligence Lab,
PhD Student, Hanyang University.
Incoming Visiting Researcher, Samsung Electronics Headquarters, South Korea