এবার প্রথম ৮০০ র তালিকায় বাংলাদেশের কোন ইউনিভার্সিটি নেই। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে বুয়েট যে ২০২১এর তালিকায় ছিল, সেটা কী হলো?

বুয়েট গতবারও প্রথম ৮০০র তালিকায় ছিল না, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ছিল, এবারও আছে। আমাদের সাংঘাতিক ভাইয়েরা হয় সেটা বোঝেন নাই, অথবা ক্লিক পাওয়ার জন্য বাদ দিয়ে লিখেছেন।

২০২০ এ বুয়েট ছিল ৪০১ থেকে ৪৫০ এর মধ্যে কোন এক স্থানে, মোট কত পয়েন্ট পেয়ে, সেটা উল্লেখ করা হয় নাই

২০২১ এ ছিল ৬৩.৪ পয়েন্ট পেয়ে ছিল ৩৪৭ তম স্থানে।

আর ২০২২ এ বুয়েট ৭২.৫ পয়েন্ট পেয়ে উঠে এসেছে ১৮৫ তম স্থানে, সাথে ৬৬.২ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে ৩৩২ তম স্থান।
ছবি দেখুন, অথবা নিচের লিংক থেকে নিজে সার্চ করতে পারবেন

https://www.qschina.cn/en/university-rankings/university-subject-rankings/2022/engineering-technology (লোকেশন এ বাংলাদেশ সিলেক্ট করা লাগবে)

এই QS ranking যদি কোন কারনে আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ন হয় (কেন, সেটা জানতে আমি আগ্রহী। কমেন্টে লিখুন), তাহলে আমাদের কী করা উচিত?

১। বাংলাদেশের উপাচার্যদের এটা নিয়ে চা-চপ-সিঙ্গাড়া মার্কা কথাবার্তা বন্ধ করা লাগবে। ভাল কিছু না বলতে পারলে অন্তত মুখ বন্ধ রাখুন।

২। স্কোর বাড়াতে হবে। কীভাবে, সেটা বোঝার জন্য কীভাবে পয়েন্ট দেয়া হয়, সেটা বোঝা লাগবে QS ranking এর মেথডোলজি থেকে।
( https://www.topuniversities.com/university-rankings-articles/world-university-rankings/understanding-methodology-qs-world-university-rankings

(শুধু এশিয়ার জন্য আরেকটা তালিকা আছে, সেটার জন্য মেথডোলজি একটু আলাদা)

ওরা পয়েন্ট দেয় এইভাবে:

Academic reputation (40%)

বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের জরিপ করা হয়, তোমার ফিল্ডে ভাল ইউনিভার্সিটি কোনগুলো। সেই থেকে আসে এই ৪০%

Employer reputation (10%)
চাকুরিদাতাদের জরিপ করে এই ১০% পয়েন্ট দেয়া হয়

Citations per faculty (20%)
Scopus নামে একটি গবেষণাপত্রের উপাত্ত ডেটাবেইস থেকে তারা বের করে, গড়ে প্রতিজন ফ্যাকাল্টি মেম্বারের গবেষণাপত্র কতবার উদ্ধৃত হচ্ছে

Faculty/student ratio (20%)

শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত। এখানে একটা ফুটনোট আছে। উপরের লিংকে এই সংখ্যাটা দেয়া হয় নাই। জেহেতু পরে বলা হয়েছে এগুলির যোগফল ১০০%, তাই এটাতে আমি ২০% বসিয়েছি।

Proportion of international faculty (5%) and proportion of international students (5%)

বিদেশী শিক্ষক আর বিদেশি ছাত্র এই দুইটা সংখ্যার ওপর নির্ভর করে ৫+৫ মোট ১০%

বাংলাদেশে রিসার্চের অবস্থা বেশ খারাপ, এটা আমরা সবাই জানি। রিসার্চ করতে টাকা লাগে, নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা লাগে।

সদ্য পেশ করা বাজেটে জিডিপি’র ১.৮৩% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ
আফগানিস্তান  জিডিপি’র ২.৪% খরচ করে শিক্ষায় আর ইন্ডিয়া করে ৩.৪৫%

যদিও এটা প্রথম ও একমাত্র কারন না, তবে বিনিয়োগের সাথে একটা দেশের ইউনিভার্সিটির গুন ও মানের সম্পর্ক আছে। সুখবর হচ্ছে, বুয়েট কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে গবেষণাপত্র প্রকাশ করানোর প্রণোদনা হিসাবে।

আশা করা যায়, এর ফলে Citations per faculty তে বুয়েটের পয়েন্ট বাড়বে, এবং সেটা দেখে বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও এগিয়ে আসবে।

অ্যাকাডেমিক রেপুটেশন বাড়াতে হলে বিদেশের ইউনিভার্সিটিগুলির প্রফেসরদের সাথে যৌথ গবেষণা করা লাগবে। উপরের প্রণোদনা এই ব্যাপারেও কাজে লাগবে।

চাকুরিদাতাদের কাছে জিজ্ঞেস করে Employer reputation এর ১০% আমার কাছে খুব অন্যায্য মনে হয়। দূর থেকে মনে হয় বাংলাদেশের সেরা ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে গিয়ে কাজ নেয়, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এরা সবাই বিদেশে গিয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি করে তারপর কাজ নেয়।

সুতরাং সাস্ট থেকে বের হওয়া যে ছাত্র এখন গুগল বা অ্যামাজনে কাজ করে, তার ম্যানেজার কিন্তু জানে সে ফ্লোরিডা থেকে মাস্টার্স করেছে, তার স্নাতক ইউনিভার্সিটি যে বাংলাদেশের শাহজালাল ইউনিভার্সিটি, এটা তাই জরিপের উত্তরে কখনই আসবে না।

(কল্পিত কিন্তু বাস্তবতার ভিত্তিতে দেয়া উদাহরণ)। ইদানিং আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করে দেশ থেকে সরাসরি গুগল মাইক্রোসফট ইত্যাদিতে কয়েকজন যাচ্ছে, কিন্তু এক লক্ষ লোকের কোম্পানিতে সেই ১০ জন গোনাতেই আসবে না।

সুতরাং এ‌ই ১০% এও আমাদের তেমন কিছু করার নেই তবে আশা করা যায় প্রথম দলের হাত ধরে এই সরাসরি নিয়োগের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়বে তবে সময় লাগবে এটা হতে।

Faculty/student ratio (20%) – টাকা ঢাললে এটার উন্নতি হতে পারে। আমি বুয়েট সম্পর্কে ব্যাক্তিগতভাবে জানি।

বুয়েটের অবস্থা খারাপ না, তবে আরো ভাল করা সম্ভব। এখানে একটা ফুটনোট—বিশ্ব তালিকায় হিসাব করা হয় না,  কিন্তু এশিয়ার তালিকায় ফ্যাকাল্টিতে পিএইচডি’র সংখ্যার ওপর পয়েন্ট দেয়া হয়।

বাংলাদেশ সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের ফ্যাকাল্টি হওয়ার সুযোগ থাকে। সম্ভবত এশিয়ার অন্য দেশেও সেটা চলে, সুতরাং কিউএস এশিয়ার জন্য পিএইচডি’র সংখ্যাকে গুরুত্ব দেয়।

পিএইচডি ফ্যাকাল্টির সাথে সরাসরি গবেষণা প্রকাশের সংখ্যা জড়িত, যেটার সাথে অ্যাকাডেমিক রেপুটেশন জড়িত, সুতরাং গ্লোবাল লিস্টে না থাকলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এটার ওপর মনোযোগ দেয়া উচিত।

Proportion of international faculty (5%) and proportion of international students (5%)

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিদেশি ফ্যাকাল্টি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কেমব্রিজ আর এমআইটি থেকে ডিগ্রিধারী প্রবাসী বাংলাদেশি প্রফেসরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মের লাল ফিতা দেখিয়ে চাকুরী দেয় নাই, সুতরাং এটা প্রাইভেটগুলির জন্য থাকুক।

(কাতার ও সৌদি আরবের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এখানে একটা কারচুপি করে। বিদেশি প্রফেসরদের এক গাদা টাকা দেয় খাতায় নাম দেখানোর জন্য যাতে QS ranking এ তাদের নাম উপরের দিকে আসে।

তবে কারচুপি শুধু মধ্যপ্রাচ্য না, অ্যামেরিকা ও বিশ্বের অন্য দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও করে, তবে শুধু খাতায় নাম লিখিয়ে টাকা দেয়ার মত ধনী তারা না, তাই সেখানে অন্য কারচুপি, যেমন সরাসরি মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়)

বাংলাদেশে বিদেশী ছাত্রছাত্রী আসে, তবে সেটাও খুব অল্প। অ্যামেরিকা, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের কয়েকটা দেশ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার সাথে পারা আমাদের জন্য তাই অসম্ভব।

এই ১০% এ বাংলাদেশী ইউনিভার্সিটিগুলি ১% ও পাবে কি না সন্দেহ আছে

উপসংহার: তাহলে আমাদের কী করা উচিত?

১) আমাদের মত ম্যাঙ্গো পিপল এর এই সব তালিকা নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল।

২) যদি সেটা করতে না পারেন, তাহলে আপনি বর্তমানে ছাত্রছাত্রী হলে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করুন

৩) যদি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আপনার কথায় পাত্তা না দেয়, অথবা যোগাযোগের কোন সুযোগ না থাকে, তাহলে ধরে নিন, তালিকায় উপরে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম। এবং সেই পরিস্থিতিতে ১ম উপদেশটি অনুসরণ করুন

লেখক- Javed Ikbal