আমি প্রায়ই আমাদের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান নানা সমস্যা নিয়ে লিখি। তবে আজ আমি বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু কথা লিখব।

পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকগুলোই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। আর আমাদের দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনটিকেই বিশ্ববিদ্যালয় বলে আমি মানতে নারাজ। আগে বলি কেন অন্য দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান এত ভালো। এর প্রধান কারণ ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যারা প্রতিষ্ঠা করেছে তারা সাংঘাতিক শিক্ষানুরাগী।

তাদের মধ্যে অমর হয়ে থাকার আর মানুষের উপকার করার বাসনা তীব্র। তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওখান থেকে মুনাফা নেননি। কল কারখানার মালিকের ন্যায় আচরণ করেনি। তাই প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আয় রোজগার যা হয়েছে সেটা আবার ফিডব্যাক (feedback) বা পুনঃবিনিয়োগ করা হয়েছে। আর আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হয় বা হচ্ছে? লুট করা হয়। যত পারে আর যেমনে পারে খালি suck করে।

ট্রাস্টি বোর্ড নামে একটি entity আছে যারা কলকারখানার মালিকের মত আচরণ করেন। আইন আছে এখান থেকে কেউ মুনাফা নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ যখন অনৈতিক আর দুশ্চরিত্রের হয় তাদেরকে কি নিয়ম দিয়ে আটকে ফেলা যায়? নিয়ম করা হয়েছে প্রতিটি নিয়োগ ও প্রমোশন বোর্ডে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা থাকবে। পৃথিবীর কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন? নিয়োগ ও প্রমোশন অত্যন্ত টেকনিক্যাল বিষয়।

যেই বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ বা প্রমোশন নিয়ে মিটিং হবে সেখানে কেবল সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞরাই থাকবে। অর্থাৎ ওই বিষয়ের শিক্ষক ও গবেষণকদের মাঝে যারা পন্ডিত তারাই থাকবে সেখানে। অন্য কারো থাকার কোন অধিকার নেই। অথচ আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বাররা যেকোন মিটিং-এ যখন ইচ্ছে তখন থাকতে পারবে এবং সিটিং এলাউন্স হিসাবে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা নেয়।

এছাড়া আরো নানান অভিনব পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় রোজগার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি এইরকম অনৈতিক কাজ চলে সেখানে ছাত্রছাত্রীরা নৈতিক নাগরিক হিসাবে কিভাবে গড়ে উঠবে?

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যার প্রধান কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয় করার পারমিশন যাদের দেওয়া হয়েছে তারা কেউ শিক্ষানুরাগী না। প্রথম দিকে যাও দুইয়েকজন শিক্ষানুরাগী ছিল পরবর্তীতে তাদের বিতাড়িত করে শতভাগ মুনাফাখোররা এর মধ্যে ঢুকে গেছে। ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বাররা যদি এইভাবে টাকা suck করে না নিত তাহলে যেই পরিমান উপার্জন এরা করে সেটার পুরোটা ফিডব্যাক করলে তরতর করে উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতো। তাদের লালসার কারণে সিএসই, বিবিএ ইত্যাদিসহ অন্যান্য বিভাগে হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি করে। প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফী প্রতিটি কোর্সর জন্য প্রায় ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।

এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নানা ফী নিয়ে থাকে। ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বাররা যদি টাকা লুটে না নিত তাহলে টিউশন একটু কম নিলেও হতো, অথবা ছাত্র ভর্তি একটু কম করলেও পারত। বেশি ছাত্র ভর্তি মানে শিক্ষকদের উপর বেশি প্রেসার। শিক্ষকদের যদি কর্মচারীর মত ৯ টা – ৫ টা করে এর মধ্যে যত ক্লাস দেওয়া যায় দেয় তাহলে আর যাই হউক গবেষণা হবে না।

বাংলাদেশের যেকোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা প্রোফাইল দেখুন। শিক্ষক হিসাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের তারা কতটুকু গবেষণা করেছে? ব্যতিক্রম দুইয়েকজন বাদ দিলে পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরলে প্রাইভেট থেকে অনেক বেটার।

বাংলাদেশের কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কি একটিও পোস্ট-ডক আছে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েওনাই। মনে রাখতে হবে যে পোস্ট-ডক আর পিএইচডি ছাত্ররাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার প্রাণ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাত্র না থাকার জন্য দায়ী আমাদের ইউজিসি। আপনি বিশ্ববিদ্যালয় করার অনুমতি দিবেন কিন্তু পিএইচডি প্রোগ্রামের অনুমতি দিবেন না এ কেমন বলদামি?

ইদানিং অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে। কারণটা কেবলই অর্থনৈতিক। এই দুইয়ের বেতনের ফারাক ব্যাপক। এই ব্যাপক পার্থক্য থাকা সত্বেও অনেকে যাবে না বা যায় না। না যাওয়ার কারণ হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এখনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশি। যদিও এই পার্থক্য সময়ের সাথে একটু একটু করে কমে আসছে। কিন্তু সেই কমাতে যেই গতিতে হতে পারতো সেই গতিতে হচ্ছে না কারণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় কখনো ব্যবসাকেন্দ্রিক হতে পারে না। দুঃখজনক হলো আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ঢুকে গেছে। যেই যেই বিভাগ বা ইনস্টিটিউটে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হয়েছে সেই সেই বিভাগের গবেষণা নেই বললেই চলে।

কারণ শিক্ষকরা যদি দিনরাত শুধু ক্লাস নিয়ে অর্থ কামানোতে মনোনিবেশ করে তাহলে গবেষণা করার সময় আসবে কোথা থেকে। সবার জন্যইতো ২৪ ঘন্টায় এক দিন।

– কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক
ঢাবি