ক’ দিন আগে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ChAdOx1 nCoV-19 এর কথা লিখেছিলাম । নতুন করোনা ভাইরাস SARS-CoV-2 এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন যুদ্ধে এই নতুন ভ্যাকসিনটি নিয়ে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রূপ এবং জেনার ভ্যাকসিন গ্রূপের Jenner Institute যৌথ ভাবে কাজ শুরু করেছিল জানুয়ারির ২০ ।

এরপর প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছিল ২৩ এপ্রিল । এই জেনার ইনস্টিটিউট প্রথম ভ্যাকসিন আবিস্কারক Dr. Edward Jenner এর নাম থেকে নেয়া । ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ এই ডাক্তার প্রথম স্মল পক্সের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়তো একটি দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে কথা হচ্ছে । প্রায় একশোটির বেশি প্রতিষ্ঠান করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে এই মুহূর্তে । এদের মধ্যে আমেরিকান National Institutes of Health (NIH) নয়টি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই বিলিয়ন ফান্ড যোগানের ব্যবস্থা করেছে । ব্রিটিশ সরকার এরকম ৪ টি প্রতিষ্ঠানকে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা দিয়েছে ভ্যাকসিন বের করতে । সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে আধা বিলিয়নের মতো ভ্যাকসিন পরীক্ষায় ফান্ড তৈরী করা হয়েছে । কানাডা প্রায় ১ বিলিয়নের উপর বিনিয়োগ করেছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে । অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি, চায়না, ফ্রান্স, কেউ এই ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই । জিও পলিটিক্সে এ নিয়ে আড়ালেও খেলা হচ্ছে কিছু ।

বিশ্বে যে এই মুহূর্তে প্রথম বের করবে, বিশ্ব তার দিকে ঝুঁকবে । চীন এবং আমেরিকার মধ্যে সে মানসিক যুদ্ধ অলরেডি শুরু হয়ে গেছে । বিশ্বকে রক্ষা করতে এই কাজের চেয়ে বড় জরুরি আর কিছু নেই । আর আমাদের দেশের লোকেরা থানকুনি পাতার মুঠো কিংবা মধু কালা জিরার মধ্যে ভ্যাকসিন খুঁজে বেড়াচ্ছে !

প্রায় ৭ টি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে শক্তিশালী ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছে । এই পদ্ধতিতে সরাসরি করোনা ভাইরাসটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে । ল্যাবে ভাইরাসটি আলাদা করে তার ভিতরের কিছু উপাদান কৃত্রিম ভাবে সরিয়ে দুর্বল বা মৃত করে ভ্যাকসিনটি বানানো হয় । এই পদ্ধতিতে তৈরী ভ্যাকসিন কে বলে Inactivated vaccine ।

তবে এই পদ্ধতি সবচেয়ে কঠিন, সময়সাপেক্ষ, রিস্কি কিন্তু শক্তিশালী । measles, polio ভ্যাকসিন এমন ধরনের ভ্যাকসিন । চীনের Sinovac Biotech এই ভ্যাকসিন তৈরিতে সবচেয়ে এগিয়ে ।

২৫ টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে Vector ভ্যাকসিন নিয়ে । এই পদ্ধতিকে বলে Recombinant Vector । ল্যাবে Adenovirus জাতের ভাইরাসের দেহে প্রোটিনের পরিবর্তন করে টার্গেট এন্টিবডি তৈরিতে শরীরকে উদীপ্ত করে । অক্সফোর্ডের ChAdOx1 nCoV-19 ভ্যাকসিনটি এই পদ্ধতিতে তৈরী করা হয়েছে ।

২০ টি প্রতিষ্ঠান Nucleic-acid vaccines নিয়ে কাজ করছে । পদ্ধতিতে করোনা ভাইরাসের RNA এর জেনেটিক কোড টি সরাসরি ঢুকিয়ে দেয়া । বাদবাকি পঞ্চাশটির বেশি Protein-based vaccines । এই প্রোটিন ভ্যাকসিনে করোনা ভাইরাসের চারপাশে থাকা প্রোটিন আবরণের রাসায়নিক উপাদান ঢুকিয়ে দিয়ে ভ্যাকসিনটি বানানো হয় ।

বিশ্বের ভ্যাকসিন গবেষকরা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির ব্যাপারে সবচেয়ে আশাবাদী । ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে শিম্পাঞ্জির দেহ থেকে একধরনের adenovirus কে ল্যাবে পরিবর্তন করে তৈরী করা ChAdOx1 ভাইরাসটিকে আরেকটু পরিবর্তন করে COVID-19 এর ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উপযোগী করে মানুষের দেহে প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে ।

মূল পরীক্ষাটি শেষ করতে প্রথমে ধরা হয়েছিল মে, ২০২১ । কর্তৃপক্ষের সকল সহযোগিতা পাওয়ায় কাজের ফলাফল আশা করেছে এই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টবরে সবচেয়ে কঠিন Phase 1 পর্বটি শেষ হবে । বেশিরভাগ ট্রায়ালের ভাগ্য নির্ধারিত হয় phase 1 এ ।

এখন কাজের গতি. অনেক বেড়েছে এবং সুফল পাচ্ছে, সাথে ভ্যাকসিন টীম ভাবছে জুলাইয়ের আগে কাজের একটা ফলাফলে এসে পৌঁছাবে । এতো দ্রুত পাওয়ার কিছু কারণ বলছি ।

২৪ এপ্রিল একজন পুরুষ এবং একজন নারীর দেহে প্রথম এই ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক ভাবে দেয়া হয়েছিল । প্রথমে পরিকল্পনা ছিল মে মাসে ৫১০ জন ভলান্টিয়ার পেলে তাদের দেহে পরীক্ষা শুরু হবে ।

ব্রিটিশ জনগণ এগিয়ে এলো দ্রুত। অনেকেই ভলান্টিয়ার খাতায় নাম লেখালো স্বেচ্ছায় । অন্যসময় এই ভলান্টিয়ার পেতে অনেক সময় লাগে । কে রিস্ক নিতে চায় ! আমাদের দেশে এসব করতে বললে দৌড়ে এসে তামাশা দেখবে, খুব কম লোক নিজেকে রিস্কে ঠেলে দেবে । জাতিগত পলায়নপর । যাইহোক, গত এক সপ্তাহে লন্ডন, ব্রিস্টল এবং সাউদাম্পটন এই তিনটি শহরের তিনটি হসপিটালে ৩২০ জনের শরীরে ট্রায়াল হচ্ছে । তৃতীয় ধাপে মে মাসে সবমিলে ১১০২ জনের শরীরে দুটো ভ্যাকসিন দেয়া হবে । দুটোর একটি হলো MenACWY নামের একটি ভ্যাকসিন, আরেকটি COVID-19 এর আসল ভ্যাকসিন ChAdOx1 nCoV-19 ।

ভ্যাকসিন ট্রায়াল এইভাবে করা হয় । একটি জানা ভ্যাকসিন এবং আরেকটি পরীক্ষার ভ্যাকসিন । এটাকে ট্রায়ালের ভাষায় বলে control for comparison । একটির সাথে আরেকটির তুলনা করে কার্যকারিতা, সাইড ইফেক্ট এসব বোঝা ।

MenACWY একটি স্বীকৃত ভ্যাকসিন, যা মেনিনজাইটিস প্রতিরোধে ব্যবহার করা হয় ২০১৫ সাল থেকে । বাংলাদেশের হজ্জ্ব যাত্রীদের হজ্বে যাওয়ার আগে এই টিকা দেয়া হয় । এটা বাধ্যতামূলক। জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে ঢুকতে এই ভ্যাকসিন দেয়া থাকতে হয় । আফ্রিকার কিছু দেশ থেকে USA ঢুকতে হলেও এই ভ্যাকসিন দেয়া থাকতে হয় ।

মেনিনজাইটিস ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার কারণে মস্তিষ্ক কিংবা স্পাইনাল কর্ডের আবরণে ইনফ্লেমেশন হওয়া । মস্তিষ্কের এই আবরণটির নাম Meninges । প্রচন্ড জ্বর এবং ঘাড় বাঁকাতে না পারা এর প্রধান লক্ষণ । এটি মারাত্মক প্রাণঘাতী এবং শরীরের কয়েকটি ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনের একটি ।

MenACWY ভ্যাকসিন দেবার মজার একটি কারণ আছে । যখন ভ্যাকসিন ট্রায়াল দেয়া হয়, ভলান্টিয়ারদের দুটি গ্রূপে ভাগ করা হয় । একটি গ্রূপকে আসল ভ্যাকসিন দেয়া হয়, আরেকটি গ্রূপকে নকল ভ্যাকসিন দেয়া হয় । তারপর তাদের উপর ফলাফলের তুলনা করা হয় । কিন্তু কোনো গ্রূপ জানে না তাকে কি দেয়া হয়েছে । এমনকি পরীক্ষা দলের বেশিরভাগ ডাক্তার কিংবা বিজ্ঞানীদেরও জানা থাকে না । টপ অল্প ক জন জানে কেবল ।

এমন করে ব্লাইন্ড রাখার কারণ হলো সবাই যাতে ভাবে সবাইকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে । করোনা ভাইরাসের ChAdOx1 nCoV-19 দিলে শরীর একটু গরম হয়ে যায়, যে হাতে দেয় সে হাত ভারী হয়ে যায়, হালকা মাথা ব্যথা করে, খানিক বমির ভাব হতে পারে । সচরাচর ট্রায়ালে নকল ভ্যাকসিন হিসাবে সেলাইন ওয়াটার দেয়া হয় । কিন্তু এই ট্রায়ালে মেনিনজাইটিস ভ্যাকসিন MenACWY ব্যবহার করা হচ্ছে ।

MenACWY ভ্যাকসিনটি দিলেও করোনা ভাইরাসের মতো শরীর গরম হয়ে যায়, হাত ভারী হয়ে যায়, মাথা ব্যথা করে, বমির একটু ভাব আসে । নরমাল সেলাইন দিলে ট্রায়ালের ভলান্টিয়াররা বুঝে যাবে যে – তাকে আসল ভ্যাকসিন দেয়া হয় নি । মেনিনজাইটিসের ভ্যাকসিন দিয়ে তাকে তখন বিভ্রান্ত করা হয়, একই সাইড ইফেক্ট হয় বলে বুঝতে পারে না, ভ্যাকসিনটি আসল নাকি নকল । রোগী অথবা ভিলান্টিয়ার, এমনকি ডাক্তার বা বিজ্ঞানী, যিনি পর্যবেক্ষন করছেন, তখন biased হবার সম্ভাবনা থাকে না ।

রোগী চাইলেও বানিয়ে কিছু বলতে পারে না । এভাবে পরীক্ষায় সঠিক চিত্রটি ফুটে ওঠে । মানুষের স্বভাব টাই এমন । এ ধরনের বিভ্রান্ত করাকে বলে Placebo effect । সাইকোলজিতে মনের উপর এমন প্রভাবকে বলে Classical conditioning । স্কুলের বইতে অনেকেই একটি গল্প পড়েছিলেন হয়তো । ১৮৯৬ সালে Ivan Pavlov নামের রাশিয়ান এক বিজ্ঞানীর কুকুরকে ঘন্টা বাজিয়ে লালা ঝরানোর গল্প । তাই অনেকে একে Pavlov conditioning বলে ।

দৈনন্দিন জীবনেও আমাদের এমন হয় । একদল লোক যদি ভদকা খেয়ে একটু মাতলামি করে এবং তাদের একজনকে শুধু স্প্রাইট খেতে দিলেও সে অন্যদের দেখাদেখি ভাববে যে সেও ভদকা পান করছে । এমনকি স্প্রাইট খেয়েই সে মাতাল হয়ে যাবে ।

অক্সফোর্ড গ্ৰুপ ইতিমধ্যে আরেকটি কাজ শুরু করেছে । পৃথিবীর ১৪ তম বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি AstraZeneca এর সাথে চুক্তিতে চলে গেছে যে – ভ্যাকসিনটি কার্যকরী প্রমাণিত হলে খুব দ্রুত যেন সারা পৃথিবীর জন্যে সাপ্লাই রেডি করতে পারে । ট্রায়ালের পাশাপাশি এটিও জরুরি । একটি ভ্যাকসিন বাজারে আসতে এটিও একটি দীর্ঘসূত্রিতা এবং অন্তরায় ।

AstraZeneca মূলত ব্রিটিশ এবং সুইডেনের দুটো বড়ো কোম্পানি Astra এবং Zeneca. ১৯৯৯ একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হওয়া একটি কোম্পানি । পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওষুধ কোম্পানি হলো Johnson & Johnson ।

সময় বলে দেবে কাজের ফলাফল কতটা দ্রুত পাওয়া যাবে ।

সূত্র:

1. Oxford University
2. Jenner Institution
3. Nature
4. Sciencemag
5. Drug Target Review
6. EBioMedicine

Dr. Opurbo Chowdhury
London, England

Read More from Same Author