অনিন্দ্য সুন্দর আর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্প ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। এসব নান্দনিক সৃষ্টিকর্ম মানুষের চিন্তাশীল সুন্দর সৃষ্টিশীলতার বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য শিল্প ও ভাস্কর্য।

বাংলাদেশও এ থেকে পিছিয়ে নেই। দেশের রাজধানী ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দৃষ্টিনন্দন ইসলামি স্থাপত্য শিল্প ও ভাস্কর্য প্রতিটি অঞ্চলের সৌন্দর্য ও পরিচিতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ঐতিহাসিক চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্ম ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে শিল্পীর তুলির আঁচড়ে নির্মিত ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্প গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর শোভা বর্ধন করেছে।

এসব শিল্পকর্মের নান্দনিক রূপ দেখে হৃদয় জুড়ায় হাজারো দর্শনার্থী ও ভ্রমণ পিপাসুরা। সংক্ষেপে এসব সৃষ্টিকর্মের কিছু তুলে ধরা হলো-

[ছবি দেখা না গেলে ব্রাউজার দিয়ে ওপেন করুন]

 আল্লাহু চত্বর, কুমিল্লা

আল্লাহর ৯৯ নাম সমৃদ্ধ ‘আল্লাহু চত্বর’ কুমিল্লার শবনম আর্ট হল দেশের প্রথম স্তম্ভ। কুমিল্লা শহরের ফৌজদারি মোড়ে আরবি শব্দে তাওহিদের কালেমা লেখা এ স্তম্ভটি উচ্চতায় ১৬ ফুট এবং ১০ ফুট ব্যাস। এতে একসঙ্গে তৈরি ৩টি স্তম্ভে বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ আল্লাহর ৯৯ নাম লেখা রয়েছে। এ ভাস্কর্যটির চূড়ায় লেখা রয়েছে ‘আল্লাহু’।

এর নিচে লেখা রয়েছে- ‘লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। তারপর উচ্চারণ ও অর্থসহ আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নাম। এর নিচে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন রঙে সজ্জিত ৬টি আরবি ক্যালিগ্রাফি।

দ্য গ্লোরি অব নামিরা, মোহাম্মদপুর

রাজধানী শহরের মোহাম্মাদপুর শিয়া মসজিদ সংলগ্ন চৌরাস্তায় নির্মিত ঢাকার প্রথম ইসলামি ভাস্কর্য ‘দ্য গ্লোরি অব নামিরা’। মহান আল্লাহ তাআলা ৯৯ নাম সম্বলিত স্তম্ভটি ৩৩নং ওয়ার্ড কমিশনার তারেকুজ্জামান রাজিবের উদ্যোগে নির্মিত হয়।

দ্য গ্লোরি অব বঙ্গবন্ধু, মোহাম্মদপুর

মোহাম্মদপুরের দ্বিতীয় দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ‘দ্য গ্লোরি অব বঙ্গবন্ধু’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে আল্লাহর তাআলার ৯৯ নাম সম্বলিত নান্দনিক স্তম্ভ মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মোড়ে নির্মাণ করা হয়।

রায়েরবাজারে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কবরস্থান নির্মাণের সুযোগ করে দেয়ায় মোহাম্মাদপুরবাসীর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে এ ভাস্কর্যটিও কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান নির্মাণ করেন।

কালেমা স্তম্ভ, ঢাকা

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে হাইওয়ে রোডে গোল চত্তরে ‘কালেমা স্তম্ভ’। দৃষ্টিনন্দন এ চত্তরে তাওহিদের কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ স্তম্ভের চুড়ায় রয়েছে মহান আল্লাহর নাম ‘আল্লাহ’।

এ চত্তরটিও দেশ-বিদেশের মানুষের হৃদয়ে বাংলাদেশের ইসলামি সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।

আল্লাহু চত্বর’ নরসিংদী

‘আল্লাহু চত্বর’ নরসিংদী সদরের রেল স্টেশন সংলগ্ন বিলাসদি এলাকায় নির্মিত হয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দর গোল চত্বরের আদলে নির্মিত পঞ্চাশ ফুট উচ্চতার ‘আল্লাহু চত্বর’-এর জন্য দেশ-বিদেশে নরসিংদীর পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে। দৃষ্টিনন্দন আল্লাহু স্তম্ভটি নির্মাণ করেন নরসিংদীর সাবেক জনপ্রিয় পৌর মেয়র প্রয়াত জনবন্ধু লোকমান হোসেন। বিসালদির এ আল্লাহু চত্বরের স্তম্ভটি দেখতে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীরা এখানে আসে।

আল্লাহু মুহাম্মদ ভাস্কর্য, ফেনী

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন ফেনীর রামপুর রাস্তার মাথায় নির্মিত হয় নান্দনিক ইসলামিক স্থাপত্য শিল্প ‘আল্লাহু-মুহাম্মাদ’ ভাস্কর্য।

ফেনী পৌরসভার মেয়র হাজি আলাউদ্দিন শহরের সৌন্দর্য বাড়াতেই ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৪ ফুট উচ্চতার ‘আল্লাহ-মুহাম্মাদ’ দৃষ্টিনন্দন স্তম্ভটি নির্মাণ করেন। রাতে আলোয় ‘আল্লাহু-মুহাম্মাদ’ স্তম্ভটি দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য লাভ করে।

কালেমা চত্বর, পিরোজপুর

দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার প্রাণকেন্দ্র বাসস্ট্যান্ড মোড়ে নির্মাণ করা হয় বিশাল ‘কালেমা চত্বর’। বাসস্ট্যান্ডের ত্রিমোহনায় ৩১৫ ফুট জায়গাজুড়ে সমলতল রাস্তা থেকে ১৫ ফুট উপরে সাড়ে ১৭ ফুটের অনেক বড় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লেখা ‘কালেমা স্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয়।

সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ব্যক্তিগত অনুদানে ১৯৯৮ সালে এটি নির্মিত। ২২ বছরের বেশি আগের নির্মিত কালেমা চত্বর আজও ইসলামের আলো ছড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

‘আল্লাহু চত্বর’ মুরাদনগর

আল্লাহর ৯৯ নাম নিয়ে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা সদর বাসস্ট্যান্ড মোড়ে। দৃষ্টিনন্দন এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন।

সংসদ সদস্য নিজেই দৃষ্টিনন্দন আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নাম খচিত ভাস্কর্যটির ড্রয়িং ও ডিজাইন করেছেন। সমতল রাস্তা থেকে ৩০ ফুট উচ্চতা এবং ১৪ ফুট গোল চত্বরে নির্মিত এ স্তম্ভে আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নাম খোদাই করে লেখা ছাড়াও ছয়টি আরবি ক্যালিওগ্রাফি টেরাকোটাসমৃদ্ধ। স্তম্ভের চূড়ায় লেখা রয়েছে ‘আল্লাহু’।

মুরাদনগর উপজেলা সদরে এ ভাস্কর্য তৈরি হওয়ায় ‘আল্লাহু চত্বর’-এ বাড়ছে দর্শনার্থীদের ভিড়। কুমিল্লা জেলার মধ্যে এ চত্বরটি বড় এবং ভাস্কর্যটি সবচেয়ে উঁচু।

মুরাদনগর উপজেলা সদরের জিরো পয়েন্টে পাথরে খোদাই করা মহান আল্লাহর ৯৯ নামের ভাস্কর্যটি বাহারি আলোকসজ্জার কারণে দিনের চেয়ে রাতেই দেখতে বেশি সুন্দর।

যা দেখতে সন্ধ্যা হতেই ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। মুরাদনগর থানা পুলিশ এ ভাস্কর্যটি রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত।

বিসমিল্লাহ চত্বর, পিরোজপুর

২০০০ সালে পিরোজপুর-ভাণ্ডারিয়া সড়কের চরখালী ফেরিঘাট চৌরাস্তায় নির্মিত নান্দনিক ‘বিসমিল্লাহ চত্বর’। রেলিংয়ে ঘেরা ৩০ ফুট উচ্চতার গম্বুজ আকৃতির ফোয়ারা চারদিকে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা ক্যালিগ্রাফি স্থাপন করা হয়। চারপাশে করা হয় সুন্দর বনায়ন।

নানান পাতাবাহার গাছ ও ফুলের গাছে সাজানো এ চত্বরের পানির ফোয়ার বর্ণিল আলোর ঝলকানি সন্ধ্যার দর্শকদের বিমোহিত করে তোলে। সড়ক ও জনপথের অর্থায়নে নির্মিত ‘বিসমিল্লাহ চত্বর’।

মাদানি তোরন, সিলেট

পীর-আওলিয়ার শহর সিলেটের নয়াসড়ক জামে মসজিদ সংলগ্ন পয়েন্টে উন্মুক্ত পরিবেশে নির্মিত হয়েছে মাদানি তোড়ন। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এ তোড়ন নির্মাণ করেন।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রখ্যাত আলেম হুসাইন আহমদ মাদানির নামে এ তোড়নের নামকরণ করা হয়। এ তোড়নের শীর্ষচুড়ায় বড় আরবি শব্দে লেখা রয়েছ মহান আল্লাহর নাম ‘আল্লাহু’।

আল্লাহ ও মুহাম্মাদ স্তম্ভ, ফেনী

ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া পৌর শহরের জমাদ্দার বাজারে চৌরাস্তা জিরো পয়েন্টে দৃষ্টিনন্দন ‘আল্লাহ-মুহাম্মাদ’ লেখা স্তম্ভটি অবস্থতি। পৌর মেয়র মুহাম্মদ মোস্তফা এটি নির্মাণ করেন। দেখতে ভাস্কর্যটি নৌকার আদলে তৈরি।

আর এর পালের আদলে তৈরি স্থাপনায় লেখা রয়েছে আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮ ফুট উচ্চতার এ স্তম্ভটি নির্মিত হয়। মহামারি করোনার কারণে এখনও এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করা হয়নি।

সুবহানাল্লাহ চত্বর, পিরোজপুর

পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার ফুলতলা বাজারের ত্রিমোহনায় নির্মিত হয়েছে ‘সুবহানাল্লাহ’ লেখা নান্দনিক ভাস্কর্য।

প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার গোলাকৃতির মিনার বা গম্বুজ আকৃতির এ স্তম্ভটি ভাণ্ডারিয়া পৌর শহর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ধাওয়া সড়কের ফুলতলা বাজারের ত্রিমোহনা সড়কে এটি অবস্থিত।

টাইলস দিয়ে ৩টি পিলারে এটি সাজানো হয়েছে। প্রতিটি পিলারে লেখা রয়েছে মহান আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নাম।

জেলা পরিষদের অর্থায়নে গড়ে তোলা মিনার আকৃতির এ ভাস্কর্যের নাম রাখা হয়েছে ‘সুবহানাল্লাহ চত্বর’। ২০১৭ সালে তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এটি নির্মাণ করেন।

বুরহান উদ্দিন রহ. চত্বর, সিলেট

সিলেট নগরীর মেন্দিবাগ এলাকায় শাহ গাজি সৈয়দ বুরহান উদ্দিন রহ.-এর নামে নির্মিত হয় একটি ভাস্কর্য। খাদিম সিরামিকস-এর অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হয়।

সিলেটের আদি মুসলিম শাহ সৈয়দ গাজি বুরহান উদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নামে এর নাম করণ করা হয়।

ভাস্কর্যটির সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ করছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডিজাইন আর্টিস্ট্রি’। এ স্তম্ভের চূড়ায় ক্যালিগ্রাফি খচিত মহান আল্লাহর তাআলা নাম ‘আল্লাহু’ লেখা রয়েছে। রাতের আলোক সজ্জায় এটি বর্ণিল হয়ে ওঠে।

কুরআন ভাস্কর্য, কসবা

দেশের প্রথম কুরআন ভাস্কর্য এটি। এর আগে বাংলাদেশে আর কেউ এ রকম ভাস্কর্য নির্মাণ করেনি।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র ভাস্কর কামরুল হাসান শিপন এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। ২০১৭ সালের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর রোববার ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

কসবা পৌর সভাপর মেয়র এমরানুদ্দীন জুয়েলের তত্ত্বাবধানে নির্মিত কুরআনের আদলে তৈরি এ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এমপি।

আল্লাহু চত্বর, নরসিংদী

আল্লাহ তাআলার ৯৯ নামের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে নরসিংদীতে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কান্দাইল বাসস্ট্যান্ডে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের উদ্যোগে স্থাপন করা হয় এটি।

মাধবদী থানার আমদিয়া ইউনিয়নের কান্দাইল বাসস্ট্যান্ডে ভাস্কর্য স্থাপনকৃত এ চত্বরটির নাম দেওয়া হয়েছে আল্লাহু চত্বর।

চত্বরটির মাঝখানে সুবিশাল একটি পিলারে চারপাশে খোদাই করে লেখা হয়েছে আল্লাহর ৯৯টি নাম এবং চূড়ায় বড় করে লেখা হয়েছে ‘আল্লাহু’। মোটামুটি দূর থেকেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে কান্দাইল বাসস্ট্যান্ডে এটি চোখে পড়ে।

তাই প্রতিদিনই দূর-দূরান্তের যাত্রীসহ ড্রাইভাররা গাড়ি থামিয়ে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন সুদৃশ্য এ ভাস্কর্যটিতে।