পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু জনমুখী প্রশ্নের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্লেষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভুল থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং উদ্ভাবন।
১. সেতুটি বক্রাকার কেন ?
– প্রথমত পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ ডিজাইন হয় বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এর মনোনীত আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত ডিজাইন ফার্ম AECOM এর মাধমে l
– পুরো সেতুটি খালি চোখে দেখলে অনেকটা S আকৃতির বাক চোখে পড়বে মূল নদীর উপরে l
– স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনীয়ররা দুই ধরণ এর লোড এর উপর খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে ডিজাইনের সময় I প্রথম টি ডেড লোড যেটা সেতুর নিজেস্স ওজন থেকে নির্ণয় করা হয় আরেকটি হইলো লাইভ লোড , যেটা আসে এর উপর দিয়ে চলমান যানবাহন , বিভিন্ন সার্ভিস লাইন ও বিদ্যুতের পিলার থেকে l
– এর বাইরে ও আরকিছু গুরুত্বপূর্ণ লোডকে এমন মেগাস্ট্রাটারের ডিজাইন এর ক্ষেত্রে কন্সিডারেশন এ আন্তে হয়েছে l তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উইন্ডলোড বা বাতাসের শক্তি , টাইডাল ওয়েভ বা জোয়ার ভাটার তীব্র স্রোতের পানির প্রেসার, ও অর্থকোয়াক বা ভুমিকম্পনজনিত লোড l এই সবগুলো লোড ই মূলত ল্যাটেরাল প্রেসার বা আড়াআড়ি চাপ তৈরী করে সেতুর মূল স্তম্ভের উপর l
– পদ্মা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা নদী। যেই স্রোতের টানে নদীর তলদেশ এ কখনো কখনো 30 মিটার বা 90 ফুট এর মতো গভীরতা তৈরী হয় l সাধারণ মানুষ এর চিন্তার ও বাইরে এমন খরস্রোতা নদীর টাইডাল প্রেসার কি রকম হতে পারে l
আরো পড়ুন পদ্মা সেতুঃ ইতিহাস ও ভবিষ্যত
এ স্থাপনাটি বক্রাকার হবার কারণ নদীর স্রোতের টান ও ডেউ একই সময় সব গুলা পিলারে আঘাত করতে পারে না , তার উপর বক্রাকার হবার কারণে রিভার্স প্রেসার তৈরী হয় , যেটা নেগেটিভ প্রেসার জোন তৌরি করে , এতে ওভারঅল প্রেসার অনেকটা ই কমানো যায় , যেটা ফাউন্ডেশন এর লোড কমানোর ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে l
– পুরা পদ্মা সেতুটি অতি ভূমিকম্প প্রবন এরিয়া এর অন্তুর্ভুক্ত l ভূমিকম্পে জন্য যে লোড বা প্রেসার স্থাপনার উপর তৈরী হয় সেটা ও লাটরাল লোড বা আড়াআড়ি প্রেসার l এই প্রেসার যাতে সেতুর উপর কমানো যায় সেই ক্ষেত্রে ও S curve একটা বড় ভূমিকা পালন করে l
– বাংলাদেশ একটি ঘূর্ণিঝড় প্রবন এরিয়া l প্রতিবছর ই ব বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় হয় l এই ঝড় গুলোতে বাতাসের গতিবেগ ১০০ কিলোমিটার এর ও বেশি থাকে l এমন গতিবেগ এর ঝড় এতবড়ো একটা ব্রিজ এর উপর কিরকম লাটরেল উইন্ড প্রেসার জেনারেট করতে পারে সেটা কল্পনার ও বাইরে l
এই প্রেসার কে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রশমিত করার একটা বিশেষ উপায় হলো বক্রাকার এস্থাপনা যার একদিকে নেগেটিভ আরেকদিকে একই সাথে পসিটিভ প্রেসার তৌরি হয় l ফলে এমন ঝরে ও স্থাপনার তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না l
আরো পড়ুন পদ্মা সেতু নির্মাণে চ্যালেঞ্জসমূহ
-ট্রাফিক সেফটি ও রিস্ক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অলোকে বলতে গেলে যখন একটি বক্রাকার পথে গাড়ি চলে , দুই দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট এর আলো ড্রাইভার এর চোখে সবচাইতে কম পরিমানে পরে , এবং তার ভিজ্যুয়াল ডিসটেন্স বেড়ে যায় ।
একটা গাড়ি যখন বক্র পথে চলে , তখন গাড়ির স্টিয়ারিং স্মুথ থাকে , এবং চালককে রাস্তাতীর পাশেরসতর্ক সূচক ইয়েলো সাইন দেখে অতিরিক্ত সতর্কতার সহিত গাড়িচালাইতে হয় l যেটা এক্সিডেন্ট কমানোর জন্য বড় ভূমিকা পালন করে l
– বক্র স্থাপনার স্থাপত্য শৈলী সরল রৈখিক স্থাপনার চাইতে অনেক বেশি l সেতুটি বাঁকা হবার কারণে রাতের বেলায় ট্রাফিক লাইট , জলের উপর আড়াআড়ি ছায়া ও ডেউ খেলানো জলের উপর সেতুর সোডিয়াম বাতির রিফ্লেকশন একটা অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে , যেটা মানুষ এর রিদ্বয় ও মনকে উদ্বেলিত করে l
২. পদ্মা সেতু তৈরী করতে এতো দীর্ঘ সময় কেন লাগলো , ব্যায়ভার ও কেন এতো বৃদ্ধি পেলো ?
– প্রথমত পদ্মা সেতু এর যখন ডিজাইন ও পরিকল্পনা করা হয় তখন খুব তাড়াহুড়া করে , অন্যান্য সাধারণ লং ব্রিজ এর কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয় l প্রমত্তা পদ্মার নদীগর্ভের মাটির ডিটেল গুনাগুন সম্পূর্ণরূপে এনালাইসিসের আওতায় আনার কথা চিন্তা করা হয়নি l
স্যাম্পল বোরিং করে পুরা সেতুর ডিটেল ডিজাইন ড্রয়িং প্রস্তুত করা হয় l স্রোতস্বীনি নদীর বুকে এমন মেগা স্ট্রাকচার নির্মাণ এর ক্ষেত্রে যেটা ছিল সবচাইতে বড় ভুল l
– এই একটি মাত্র ভুল পুরো সেতুর কাজকে দুইবছর পিছিয়ে দিয়েছে l
– এর মাঝে ২০১৫ সালের প্রবল বন্যায় সেতুর দুই পাশের কনস্ট্রাশন ইয়ার্ড পুরো বিলীন করে দেয় l এ কারণে কনস্ট্রাকশন কাজ ও অনেকদিন বন্ধ ছিল l
– ডিজাইন টীম এর প্রত্যেক পিলার লোকেশন এ সয়েল টেস্ট না করে যে ইঞ্জিনিয়ারিং ভুল করেছিলেন , সেটার সমাধানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ইতিহাসে জন্মহয় নতুন প্রযুক্তি মাইক্রোগ্রাউটিং পাইল ইঞ্জিনিয়ারিং l
পিলার এর চারপাশের মাটিতে মাইক্রোগ্রাউটিং এর মাদ্দমে বন্ড তৈরির নতুন কৌশল যেটা একমাত্র পদ্মা সেতুর পাইল এর ক্ষেত্রে ই সর্ব প্রথম ব্যবহার করা হয়াছে ।
মাইক্রোফাইবর গ্রুট আশেপাশের মাটিতে পিলার এর চারপাশে অনেকটা গাছের গুস্সামুল এর মতো কাজ করে l এই পদ্দ্বতিটা পরীক্ষা করে প্রমান ও কর্যকরী করার জন্য দীর্ঘ দুইবছর সময় লেগে গেছে l
– সেতুর প্রাথমিক টেন্ডার এ কার্ভ পাইলিং ও ফাইবার গ্রুটিং অন্তুর্ভুক্তি ছিলোনা l এই নতুন কাজ ও প্রযুক্তি সেতুর খরচ বাড়ানোতে একটা বোরো ভূমিকা পালন করেছে l
– প্রত্যেকটা পাইলের উপরের মাথা ও নিচের প্রান্ত আড়াআড়ি হবার কারণে , চারপাশের সয়েল ও একটা লোডবেয়ারিং এলিমেন্ট হিসাবে কাজ করে l সাথে পাইলের সারফেস ফ্রিকশন ক্যাপাসিটি ও বেড়ে যায়।
পাইলের দুই মাথার মদদে সরল রৈখিক দূরত্ব ২০ ফুট এর মতো যেটা সাধারণ পাইল এর ক্ষেত্রে ০ ধরা হয় l প্রত্যেকটা পিলার এর নিচে ৬ টা পাইল আড়াআড়িভাবে বসিয়ে অনেকটা স্পাইডার বা মাকড়সার জালের মতো তৌরি করা হয়েছে l
তার উপর ফুটিং বানিয়ে পিলার উঠিয়ে , সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে l এমন প্রযুক্তি পদ্মা সেতুতেই প্রথম ব্যবহার হয়েছে , তাই খরচ বাড়াতে হয়েছে l
– বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল এক্সপার্ট টীম , কনসালটেন্ট সবাই একযোগে চলে যাওয়ায় , দেশীয় এক্সপার্ট প্যানেলকে অনেক সময় ও অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়েছে , অন্য কোম্পানিকে দিয়ে ডিসাইন মোডিফাই করানোর জন্য l
– বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে মিডল ইস্ট এ একযোগে অনেকগুলো দেশ এ যুদ্ধ বাধার কারণে , কনস্ট্রাশন ম্যাটেরিয়ালস এর দাম কয়েক গুন্ বেড়ে যায় l
– সর্বশেষ করোনা মহামারী সারাবিশ্বের সাস্থ ও অর্থনীতির চাকা এমন ভাবে ভেঙ দিয়েছে যে , প্রকল্পের সময় ও অর্থ দুয়োটা ই বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা l
পরিশেষ এ এতো গুলা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা , আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র , ও ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এমন একটি মেগা প্রকল্প সফল ভাবে সম্পন্ন করার জন্য এর পিছনের কারিগরদের এই জাতি সারা জীবন মনে রাখবে
নিজের গত 15 বছর এর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেগাপ্রকল্পে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসাবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে পুরো বিষয়টি মূল্যয়নের ক্ষুদ্র চেষ্টা করেছি l
যাদের এই মেগাস্ট্রাকচার নিয়ে ডিটেল পড়ার আগ্রহ আছে তাদের জন্য AECOM এর প্রকৌশীদের কর্তৃক আন্তর্জাতিক জার্নাল প্রকাশিত পদ্মা সেতু বিষয়ক ডিজাইন ফিচার ও চ্যালেঞ্জ আর্টিকেল সংযোগ করে দিলাম l
পিডিএফ পড়তে এই লিংক ভিজিট করুন
নিবেদক
Eng.Zobayer Ahmed,
B.Sc.Engg.Civil, BUET,
M.Engg.Safety & Risk , MUN, Canada,
PMP, LEEDS & ISO 9001-2015 Certified Quality Auditor,
Formal Project Manager, RITCO Royal Corporation, Korea,
EX. DGM-Head of Planning Abdul Monem Group