বাইরে যারা পড়তে যাবে তাদের কাছ থেকে আমি মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন পাই যে, বাইরে হায়ার স্টাডি করতে আসার সময় কীভাবে প্রফেসর সিলেক্ট করতে হবে?

অনেকে যেমন থাকে যে কোন একজন প্রফেসর হলেই চলে আসবে, সবাই কিন্তু তেমন না।

অনেকেই কোন প্রফেসরের সাথে কাজ করবে, কাজ কেমন হবে, লাইফ কেমন হবে, ভবিষ্যৎ কেমন হবে – এইসব নিয়ে চিন্তা করে। তারা এই ধরণের প্রশ্নটা বেশি করে।

অর্থাৎ, প্রফেসর যেমন শিক্ষার্থী সিলেক্ট করে, শিক্ষার্থীও কিন্তু প্রফেসর সিলেক্ট করে। এবং প্রফেসর সিলেকশনের ওপরে ইউনিভার্সিটি সিলেকশনও কিন্তু অনেকাংশে নির্ভর করে।

এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই এক এক জনের কাছে এক এক রকম। আমি নিজে প্রফেসর হবার পর থেকে এই বিষয়টা নিয়ে আমি পড়াশোনা করা ও মানুষজনের সাথে কথা বলা শুরু করি।

আমার উদ্দেশ্যটা ছিল এই যে, আমি নিজে সেইরকম প্রফেসর হতে চাই যা স্টুডেন্টদের জন্য উপকারি। যাই হোক, আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে MIT, Stanford, Harvard, Cornell, Berkeley, Princeton, Toronto, Waterloo, UBC সহ ৩৮ টি উত্তর আমেরিকার ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের সাথে কথা বলেছি শেষ ৩ বছরে।

একই সাথে আমি ৬৭ জনের ওপরে গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের সাথে এই বিষয় বিভিন্ন পরিসরে আলাপ করেছি।

এইসব পড়াশোনা ও আলাপআলোচনার ওপরে ভিত্তি করে আমি এই বিষয়গুলোর লিস্ট তৈরি করেছি।

বিষয়গুলো গুরুত্বের ক্রম অনুযায়ী সাজানোঃ

১) মানবিকতা – আমার মনে হয় একজন ছাত্র যার অধীনে কাজ করবে তার মানবিক হওয়া খুব দরকার।

দেশে থেকে হয়ত এই ব্যাপারটা অনেকসময় পরিষ্কার বোঝা যায় না, কিন্তু একজন প্রফেসরের মানবিক গুনাবলীর ওপরে একজন শিক্ষার্থীর শুধু মানসিক ও শারীরিক অবস্থাই ভাল থাকে তা নয়, তার কাজ কর্মেও উন্নতি হয়।

একজন শিক্ষার্থী একজন প্রফেসরের অধীনে বছরের পর বছর কাজ করে। এর মধ্যে অনেক ভাল-মন্দ সময় আসবে তার জীবনে, অনেক পরিবর্তন আসবে – সেটাই স্বাভাবিক।

সবসময় সমান হারে পারফর্ম করা কারও পক্ষে সম্ভব না। আবার কাজের ক্ষেত্রে উৎসাহের পরিবর্তে নেগেটিভ কথা শুনলে একজন শিক্ষার্থী চরম মানসিক সমস্যাতে পড়ে যায়।

আমি উত্তর আমেরিকাতে এমন অনেক মাস্টার্স/পিএইচডি স্টুডেন্ট পেয়েছি যারা তাদের প্রফেসরের অমানবিক আচরনের কারণে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছে।

দুর্জন যেমন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য, সেরকম এই ধরণের প্রফেসর পরিত্যাগ করা উচিৎ। প্রফেসর সাপোরটিভ ও ভাল মানুষ হওয়া সবচেয়ে দরকারি গ্র্যাজুয়েট লাইফে।

সমস্যা হল, কীভাবে বুঝব একজন প্রফেসর মানুষ হিসাবে কেমন? এটা আসলে একটা কঠিন কাজ।

এইজন্য সেই প্রফেসরের সঙ্গে আগে কাজ করেছে এমন কারও সাথে যোগাযোগ করলে ভাল হয়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে প্রফেসরের সাথে তাদের কাজের ধরণ কেমন ছিল, তারা কী কী ধরণের আচরণবিধি মেনে চলত, ইত্যাদি।

সবসময় এইরকম তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় প্রফেসরের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করলেও কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

২) রিসার্চ পোটেনশিয়াল – এটা খুব দরকারি বিষয়, বিশেষ করে মাস্টার্স বা পিএইচডি স্টুডেন্টদের জন্য। ভাল বিশ্ববিদ্যালয় হলেও সব প্রফেসর রিসার্চে সমান পারদর্শী না।

আপনি যেহেতু আপনার জীবনের একটা বড় সময় একজনের কাছে রিসার্চ শিখতে ব্যয় করবেন তাকে রিসার্চে দক্ষ হওয়া জরুরী।

এখন দেশে থেকে আমরা কীভাবে বুঝব যে, একজন প্রফেসর একটা রিসার্চ লাইনে দক্ষ? সব প্রফেসরই তো নিজের প্রোফাইলে বড় বড় কথা লিখে রাখে, অনেক ফাপড় নেয়।

অনেকেরই তো অনেক অনেক গ্র্যান্ট আর এওয়ার্ড। তাহলে উপায়?

একটা সহজ উপায় হল, ওই প্রফেসর নিজেকে যেই লাইনের রিসারচার বলে দাবী করে সেই লাইনে টপ রিসার্চ ভেন্যুতে তার নিয়মিত পাব্লিকেশন আছে কি না সেটা চেক করা।

যেমন ধরুন, আমি কাজ করি হিউম্যান-কম্পিউটার ইন্টারএকশন এরিয়াতে। আমার এরিয়ার টপ রিসার্চ ভেন্যু কোনটি? একটু ঘাটলেই পেয়ে যাবেন (CHI)।

তাহলে কেউ যদি নিজেকে HCI এরিয়ার বড় রিসারচার হিসেবে দাবী করে তার নিয়মিত CHI তে পেপার আছে কি না দেখতে হবে। জীবনে একবার-দুইবার পাব্লিশ করে থাকলে সেটা নিয়মিত না।

আবার ধরেন কেউ বলল, আমি মেশিন লার্নিং এর এক্সপার্ট। তাহলে মেশিন লার্নিং এর টপ চারটি ভেন্যু NeuroIPS, ICML, CVPR, KDD তে তার নিয়মিত পেপার আছে কিনা দেখে নিন।

এর বাইরের ভেন্যুগুলোতে পাব্লিশ করা ভাল, তবে টপ ভেন্যু বাদ দিয়ে নয়।

টপ জায়গায় যে নিয়মিত পাব্লিশ করে তার কাছ থেকে আপনি শিখতে পারবেন ওই এরিয়াতে টপ কাজ করার উপায়। নাহলে আপনার দৌড়ও কিন্তু একটা পর্যায়ে যেয়ে আটকে থাকবে।

৩) স্টুডেন্ট প্লেসমেন্ট – একজন প্রফেসর এডভাইজিং এ কতখানি ভাল সেটা বোঝা যায় তার কাছ থেকে পাশ করা স্টুডেন্টরা কোথায় প্রথমে চাকরি পেয়েছে সেটা দেখলে।

যদি দেখেন যে প্রফেসরের স্টুডেন্টরা টপ স্কুলে ফ্যাকাল্টি হচ্ছে বা টপ ইন্ডাস্ট্রিতে রিসার্চ পজিশনে জয়েন করছে, তাহলে বুঝবেন যে সেই প্রফেসরের কাজ বাইরের মানুষ দাম দেয় এবং সে ভালভাবে স্টুডেন্ট তৈরি করতে পারে।

মনে রাখবেন, বড় ইউনিভার্সিটির অনেক বড় প্রফেসরও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিজের অধীনস্থ শ্রমিকের মত খাটায় এবং তাদেরকে স্বাধীন গবেষক হবার সুযোগ দেয় না।

পরবর্তীতে স্টুডেন্টরা কোনরকমে ছোটখাট একটা চাকরি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে। সেইরকম প্রফেসরের কাছে গেলে আপনার শেখার সুযোগ ছোট হয়ে আসবে।

এখানে উল্লেখ্য, নতুন প্রফেসরদের ক্ষেত্রে আপনি এই ডেটা কম পাবেন, কারণ তাদের কোন ছাত্র-ছাত্রী হয়ত পাশই করে নাই এখনও।

সেক্ষেত্রে আপনি সরাসরি এই ব্যাপারে প্রফেসরের সাথে কথা বলুন।

৪) আইডেন্টিটি এবং এক্সপোজার – একজন প্রফেসরের অধীনে তার স্টুডেন্টদের কাজগুলো কতখানি এক্সপোজার পাচ্ছে সেটা বোঝা দরকারি।

এটা বোঝার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল, প্রফেসরের নিজের মূল কাজ থেকে তার স্টুডেন্ট এর কাজ কতখানি আলাদা সেটা পরখ করে দেখা।

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, স্টুডেন্টের কাজটা প্রফেসরের বড় কাজের একটা অংশবিশেষ মাত্র। সুতরাং সেই কাজ দিয়ে স্টুডেন্টটা কখনই আলাদাভাবে রিকগনিশন পাবে না।

তাছাড়া পাশ করার পরে ওই স্টুডেন্ট যদি প্রফেসর হয় এবং কোন গ্র্যান্টের জন্য এপ্লাই করে যেখানে তার প্রফেসরও এপ্লাই করছে, তাহলে স্টুডেন্টের সম্ভাবনা কমে যাবে।

কারণ, তার প্রফেসর ওই একই বিষয়ে আরও বড় প্রজেক্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে এপ্লাই করবে।

এডভাইজিং এর এই জায়গাটা খুব আর্টফুল এবং চ্যালেঞ্জিং একটা প্রফেসরের জন্য। একটা শিক্ষার্থীকে তার নিজের গ্র্যান্ট থেকে ফান্ড করতে হয়, তাই খুব বেশি আলাদা কাজ করতে দেওয়াও সম্ভব হয় না।

তাছাড়া যেই কাজ প্রফেসর নিজেই ভাল পারে না, সেটা এডভাইজ করবে কী করে? অন্যদিকে স্টুডেন্টের নিজের আইডেন্টিটি ডেভেলপ করার জন্য তার কাজ আলাদা হওয়া দরকার।

এই দুটো লক্ষ্যকে এক করে এডভাইজিং করা বেশ কঠিন। অনেক সফল প্রফেসর সেজন্য প্রতিটা স্টুডেন্টের জন্য আলাদা করে লেখাপড়া করে, প্রজেক্ট দাঁড় করায়, সেই স্টুডেন্টদের জন্য আলাদা গ্র্যান্ট লিখে এবং সেখান থেকে সেই স্টুডেন্টকে বিকাশ লাভ করার সুযোগ করে দেয়।

এটা অনেক কষ্টের কাজ এবং শুধুমাত্র ডেডিকেটেড প্রফেসররাই সেটা করে। প্রসঙ্গত, আমি খুব সৌভাগ্যবান ছিলাম যে, আমার প্রফেসর আমি কর্নেলে থাকতে আমার প্রজেক্টের জন্য এনএসএফ এ গ্র্যান্ট লিখে আমাকে সাপোর্ট করেছিল।

যারা সেটা করবেন না, তারা অন্তত স্টুডেন্টের নিজের প্রজেক্টের জন্য আলাদা সময় দেবেন, এবং অন্যান্য কমিটি মেম্বার এমনভাবে সেট করবেন যেন স্টুডেন্টের প্রজেক্ট যথেষ্ট পরিমাণে আলাদা হয়।

দেশে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক সময় এই বিষয়গুলোর দরকার অনুভব করে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।

চেক করতে হবে যে, স্টুডেন্টরা তাদের নিজেদের প্রজেক্ট গ্রো করছে কি না যা তার এডভাইজরের কাজ থেকে যথেষ্ট আলাদা। তারা যেন এডভাইজরের ছায়ায় ঢাকা না পড়ে যায়। ব্যক্তিগত রিকগ্নিশন পায়।

৫) ফান্ডিং – এটা অত্যন্ত দরকারি বিষয়, কিন্তু সঙ্গত কারণেই আমি এটাকে ৫ নাম্বারে রেখেছি। আমি যতজনের সাথে আলাপ করেছি তারা সবাই ফান্ডিং এর দরকারের কথা বলেছে তবে সেটার সাথে অনেক কিছু জড়িত।

প্রথম কথা হল, প্রফেসরের শুধু সেই পরিমাণ ফান্ডিংই থাকা দরকার যেটা স্টুডেন্ট এর লাগবে (স্যালারি, ট্রাভেল, ইন্সট্রুমেন্ট, ইত্যাদি)।

এর বাইরে প্রফেসরের ১ মিলিয়ন নাকি ১০ মিলিয়ন গ্র্যান্ট আছে, তাতে কিছু যায় আসে না। বরং, অনেকেই বলেছে যে, অনেক বেশি গ্র্যান্ট থাকা প্রফেসররা স্টুডেন্টদের জন্য কম সময় পায়, এবং এডভাইজিং কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়, বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসরের ফান্ডিং না থাকলেও বিকল্প উপায়ে সাপোর্ট পাবার অপশন রাখে। সেগুলোর কারণে স্টুডেন্টদের সমস্যা হয় না।

তৃতীয়ত, এডভাইজর যদি চৌকস গবেষক হয় এবং ছাত্র-ছাত্রীর যদি যথেষ্ট ভাল রিসার্চ আউটপুট থাকে তাহলে দরকারি গ্র্যান্ট বা ফেলশিপ/স্কলারশিপ এসব পাওয়াও আসলে কঠিন না।

সুতরাং, ফান্ডিং দরকারি বিষয় তবে প্রথম ও প্রধান বিষয় নয়। আমাদের দেশের অনেকে শুরুর ব্যাপারগুলো চিন্তা না করে প্রথমেই ফান্ডিং এর দিকে নজর দেয়। এটাকে ভাল স্ট্র্যাটেজি বলে মনে করা হচ্ছে না।

এর বাইরে যেই যেই ব্যাপারগুলো দেখার কথা বলা হয় তার মধ্যে আছে রিসার্চ গ্রুপ কালচার – প্রফেসর কীধরণের পরিবেশ রাখে গ্রুপে? ফ্রেন্ডলি নাকি সাফোকেটিং – সেটা দেখা দরকারি।

এরপর আছে প্রফেসরের নিজের স্ট্যামিনা। অনেকেই বলেছে প্রফেসর নিজে অনেক পরিশ্রমী এবং মেধাবী না হলে স্টুডেন্টরা কনফিডেন্স এবং মোটিভেশন পায় না।

এরপর আছে, অন্য রিসারচার এবং রিসার্চ গ্রুপের সাথে কোলাবরেশন, এবং স্টুডেন্টকে ট্রাভেল করানো। এর বাইরের আরও কিছু ছোটখাট বিষয় আছে যেগুলো উহ্য রাখলাম আপাতত।

আশা করি অনেকের উপকার হবে এই পোস্ট থেকে।

লেখকঃ ইশতেয়াক আহমেদ

সহকারী অধ্যাপক

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ

টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়

সাবেক শিক্ষার্থী

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিষয়ে আরো জানতে যোগ দিন আমাদের রিসার্চ কমিউনিটি গ্রুপে