টিএসসির নকশাকার কে ছিলেন, কী ছিল তাঁর অনুপ্রেরণা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ভেঙে নতুন রূপে গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনা ভাঙা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।

পড়ুনঃ টিএসসি চত্বর ভেঙে তৈরি হবে বহুতল কমপ্লেক্স

এ পরিস্থিতিতে আলোচনায় উঠে এসেছে গ্রিক স্থপতি কনস্ট্যানটিনস অ্যাপোস্টলোউ ডক্সিয়াডিসের নাম। কারণ, তিনিই টিএসসি কমপ্লেক্সের নকশা করেছিলেন।

দেশের একজন স্থপতি জানিয়েছেন, টিএসসির নকশা করার ক্ষেত্রে ডক্সিয়াডিস বাংলাদেশের গ্রামীণ বসতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সমাদৃত স্থপতি ডক্সিয়াডিস এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নান্দনিক স্থাপনার নকশা করেছেন।

বাংলাদেশে শুধু টিএসসিই নয়, ঢাকায় হোম ইকোনমিকস কলেজ, কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমিসহ কিছু স্থাপনার নকশা করেন তিনি। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের পুরো শহরের নকশা তৈরি করা হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই।

ডক্সিয়াডিস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট ডক্সিয়াডিস ডট ওআরজির তথ্যমতে, কনস্ট্যানটিনস অ্যাপোস্টলোউ ডক্সিয়াডিসের জন্ম ১৯১৩ সালে বুলগেরিয়ায় এক গ্রিক পরিবারে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার গ্রিসে চলে যায়। ১৯৩৫ সালে এথেন্স টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন কনস্ট্যানটিনস ডক্সিয়াডিস।

১৯৩৭ সালে তিনি এথেন্সে প্রধান নগরপরিকল্পনাবিদ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি গ্রিসের আঞ্চলিক ও নগরপরিকল্পনা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কনস্ট্যানটিনস অ্যাপোস্টলোউ ডক্সিয়াডিসছবি: ডক্সিয়াডিস ডট ওআরজি

কনস্ট্যানটিনস অ্যাপোস্টলোউ ডক্সিয়াডিস। ছবি: ডক্সিয়াডিস ডট ওআরজি

১৯৭৫ সালের ২৮ জুন ৬২ বছর বয়সে ডক্সিয়াডিসের মৃত্যু হয়। এর পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস তাঁকে নিয়ে বড় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এর শুরুতেই বলা হয়, ডক্সিয়াডিসের কাজ বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে গ্রিসের পুনর্গঠনে যে স্থপতিরা ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ডক্সিয়াডিস।

এস্থেটিক্স (সৌন্দর্যজ্ঞান) ও স্থাপত্য ( ডিজাইন বিয়ন্ড ফাংশন)

তিনি নিজের কাজে ঐতিহ্য ও নতুন ধারণার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।

ডক্সিয়াডিসকে বলা হয় ‘অ্যাকুস্টিকস’ তত্ত্বের জনক। এই তত্ত্বে মানববসতির পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থান, বাস্তুসংস্থান, স্থানীয়দের মানসিকতা, নৃতত্ত্ব, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ের মনোযোগ দেওয়া হয়।

আরো পড়ুনঃ পৃথিবীর সেরা ৫০ চিন্তাবিদের তালিকায় বাংলাদেশের স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম

নিজের কাজের ধারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডক্সিয়াডিস একবার বলেছিলেন, ‘অ্যারিস্টটল (গ্রিক দার্শনিক) বলেছেন, নগরের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সুখী আর নিরাপদে রাখা। আমি এর চেয়ে ভালো কোনো সংজ্ঞা খুঁজে পাইনি।’

ডক্সিয়াডিস টিএসসির নকশা করার ক্ষেত্রে এ দেশের সংস্কৃতি ও আবহাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এ দেশের গ্রামীণ বসতির চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে।

ফাতেমা তাসমিয়া, সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা তাসমিয়া বাংলাদেশে ষাটের দশকে আগত স্বনামধন্য কয়েকজন বিদেশি স্থপতির নকশা করা স্থাপনা নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তিনি বলেন, ডক্সিয়াডিস টিএসসির নকশা করার ক্ষেত্রে এ দেশের সংস্কৃতি ও আবহাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এ দেশের গ্রামীণ বসতির চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিসরে ও স্থাপনার প্রাণকেন্দ্রে উঠান থাকে, সেটিকে কেন্দ্র করে মানুষ ঘর করে বসবাস করে। টিএসসিতেও দেখা যাবে এর প্রাণকেন্দ্রে উঠানের মতো মাঠ রয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের কোলাহল।

Tsc

টিএসসি’র প্রাণকেন্দ্রে উঠানের মতো মাঠ রয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের কোলাহল।

ফাতেমা তাসমিয়া বলেন, শুধু স্থপতিরা নন, যেকোনো সচেতন মানুষই টিএসসির মতো একটি স্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে ফেলার বিপক্ষে থাকবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঐহিত্যবাহী পুরোনো স্থাপনা

রক্ষা করে উন্নয়ন কাজ করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে টিএসসি কমপ্লেক্স তো এখনো শক্ত রয়েছে। জরাজীর্ণ হয়নি।

লেখকঃ রাজিউল হাসান

আরো পড়ুনঃ Architecture Department Review