যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত এক জরিপে এ বছরের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এ মামুন।
ড. মামুন প্লাজমা ফিজিক্সে অবদানের জন্য জার্মান চ্যান্সেলর পুরস্কার পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে একাধিকবার ‘বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’ গোল্ড মেডেলসহ দেশ-বিদেশে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
এই বহুগুণে গুণান্বিত মানুষটির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শেখ তাজুল ইসলাম।
শেখ তাজুল: অভিনন্দন পৃথিবীর সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় জায়গা করে নেওয়ার জন্য। সম্প্রতি আপনার অর্জন নিয়ে অনুভূতি জানতে চাই।
ড. এ এ মামুন: যেকোনো স্বীকৃতিই আরও এগিয়ে যাওয়ার পথে অনুপ্রেরণা দেয়। আমাকে যখন বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স থেকে জুনিয়র গোল্ড মেডেল ও পরবর্তী সময়ে সিনিয়র গোল্ড মেডেল দেওয়া হলো, ওইটা আমাকে অনেক উদ্বুদ্ধ করেছিল। যখন নিজে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, কমনওয়েলথ পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি পেলাম, তখনো আমি আরও বড় স্বপ্ন দেখতে শিখেছি।
‘হোমবোল্ট পোস্টডক ফেলোশিপ’ আমাকে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে, আরও উন্নতমানের গবেষণার সুযোগ দিয়েছে। যেদিন আমি জার্মানি থেকে সম্মানজনক ‘ব্যাসেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ পেলাম, আমি ওইরাতে আনন্দে ঘুমাতে পারিনি। কারণ এটা খুবই সম্মানজনক একটা অ্যাওয়ার্ড। নোবেল প্রাইজের পরেই সম্মানীর দিক থেকে এটা সর্বোচ্চ। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আমি যখনই চাইবো তিনমাস করে জার্মানি থাকতে পারবো, যদি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি পাই। এককথায় পর্যায়ক্রমে আমি যে সম্মাননা পেয়েছি, এগুলো আসাকে আরও উদ্বুদ্ধ করেছে।
শেখ তাজুল: বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, পরিবার ও অনুপ্রেরণা সম্পর্কে যদি আমাদের জানাতেন।
ড. এ এ মামুন: আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। বাড়ি ধামরাইয়ে হওয়ায় ও জাহাঙ্গীরনগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে সুযোগ পেয়েও পড়িনি। আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে। তিনি আমাকে ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ড. মামুন বলে ডাকতে পছন্দ করতেন।
শেখ তাজুল: আপনি একইসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও গবেষক। এত কিছু একসঙ্গে সমন্বয় করেন কীভাবে?
ড. এ এ মামুন: চাইলেই সম্ভব। পড়ানো আমার পেশা আর গবেষণা আমার নেশা। ১৫টির কম গবেষণাপত্র নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়া সম্ভব, কিন্তু আমার গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৪৫০টিরও বেশি। এটা এখন আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। আমি নতুন কোনো আইডিয়া মাথায় আসলেই পুরো পৃথিবীকে সেটা জানাতে ব্যস্ত হয়ে যাই। আমার ২০ জনের মতো ছাত্রছাত্রী বিদেশে পিএইচডি করছে, পোস্ট ডক্টরেট করছে, এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। আমি আমার কাজ উপভোগ করি, যার কারণে আমার তেমন সমস্যা হয় না।
শেখ তাজুল: পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে আসা কি নিজের ইচ্ছাতেই? যদি আবার সুযোগ পেতেন, তাহলে কোন বিষয় নিয়ে পড়তেন?
ড. এ এ মামুন: অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞানে পড়তে চাই। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে চাই। কারণ, আমি মনে করি গবেষণা করার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে উপযোগী জায়গা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
শেখ তাজুল: ছোটোবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?
ড. এ এ মামুন: ছোটো থাকতে তো বুঝতাম না, সবাই বলতো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। কিন্তু, আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম, ওই সময় আমার এক বড়ভাই, যিনি বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে গেলেন। ওটা আমাকে অনেক উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমিও তখন স্বপ্ন দেখেছিলাম বাইরে পড়তে যাওয়ার।
শেখ তাজুল: আপনি টানা তিনবারের দেশসেরা ও বর্ষসেরা গবেষক। জার্মানির হোমবোল্ট পোস্টডক ফেলো আপনি। একজন গবেষক হিসেবে গবেষকের কী কী দক্ষতা ও গুণাবলী থাকা উচিত বলে মনে করেন?
ড. এ এ মামুন: কাজ করতে হবে, স্বপ্ন দেখতে হবে। গবেষণাকে নেশার মতো নিতে হবে। শিক্ষক হওয়ার জন্য নয়, বরং জানান জন্য। জানানোর জন্য গবেষণা করতে হবে। আপডেটেড থাকতে হবে। ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ এমন হলে চলবে না।
শেখ তাজুল: আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণায় আগ্রহ ও গবেষণাপত্রের মান কেমন বলে মনে করেন?
ড. এ এ মামুন: বাংলাদেশে এখন ভালো কাজ হচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা বেশ মেধাবী। তবে আগ্রহ তৈরি করে দিতে হবে তাদের ভেতর। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। আরও উন্নত গবেষণা করার সুযোগ করে দিতে হবে।
শেখ তাজুল: শিক্ষা ও গবেষণাখাতে যে বরাদ্দ হয়, সেটা পর্যাপ্ত বলে কি মনে করেন?
ড. এ এ মামুন: আসলে অপর্যাপ্ত বলবো না। কারণ, অর্থের অভাবে গবেষণার কাজ থেমে যেতে খুব কমই দেখেছি। তবে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আমি আমার নিজের টাকায় নিজে সবকিছু কিনে গবেষণা করেছি এমনো হয়েছে। আর সব খাতে জিজ্ঞেস করলেই বলা হবে যে বরাদ্দ কম। কিন্তু আমরা গরিব দেশ হিসেবে আমি মনে করি সম্ভব হলে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতেও গবেষণার সুযোগ একদমই অপ্রতুল নয়।
শেখ তাজুল: বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে গবেষণার সময়ে কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
ড. এ এ মামুন: প্রতিবন্ধকতা তো অনেক এসেছে জীবনে। কিন্তু সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারাটাই প্রকৃত সফলতা। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। সব সমস্যারই সমাধান রয়েছে। শুধু সমাধানের পথটা জানতে হবে।
শেখ তাজুল: আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন কীভাবে সম্ভব?
ড. এ এ মামুন: আসলে সীমাবদ্ধতা নেই এমন বলবো না, তবে আমাদের দেশে প্রচুর মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছেন। জার্মানিতেও আমাকে বলা হয়েছে ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্টেও প্রচুর মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছেন। সত্যেন বোস-এর মতো মানুষ আমরা পেয়েছি। তবে, শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ ও তদারকি আরও বাড়ানো উচিত। ভালো তদারকি ব্যবস্থা ও উন্নত গবেষণার সুযোগ থাকলে আমাদের গবেষকরা আরও ভালো করতে পারবে।
শেখ তাজুল: গবেষণা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
ড. এ এ মামুন: একটা হাসপাতাল করছি আমার গ্রামের বাড়িতে। আমার সব সম্মাননা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ‘ড. এ এ মামুন ট্রাস্ট’ নাসে একটি ট্রাস্ট করে যাওয়ার ইচ্ছা আছে, যেটা গবেষণা করতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেবে। এই দেশ, এই দেশের মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখি। আমি ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু আমি যাইনি। আমি এ দেশেই মরতে চাই।
শেখ তাজুল: অবসর সময়ে কী করতে পছন্দ করেন?
ড. এ এ মামুন: অবসর সময়েও আমি আমার গবেষণা করতেই বেশি পছন্দ করি। ল্যাপটপ নিয়ে বসে যাই গবেষণার কাজে। দেশে গবেষণার মানোন্নয়ন, ভালো গবেষক তৈরি, গবেষণায় ছাত্র-শিক্ষকদের আগ্রহ কীভাবে বাড়ানো যায়, এটা নিয়েই বেশি ভাবি। এছাড়া স্বপ্ন দেখি, পরিকল্পনা করি দেশের মানুষের জন্য কাজ করার।
শেখ তাজুল: আপনি যাদের কাছে আদর্শ হয়ে আছেন, সেই শিক্ষার্থীদের জন্য কী উপদেশ দিতে চান?
ড. এ এ মামুন: আমার শিক্ষার্থীদের আমি সবসময় বলি, চোখ খুলতে হবে, স্বপ্ন দেখতে হবে আর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে হবে। আমার ছাত্ররা অনেকে এখন বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারাও হোমবোল্ট ফেলোশিপ পেয়েছে, একজনের জীবনবৃত্তান্ত ইউরোপিয়ান একটা জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে।
এগুলো আমাকে অনেক আনন্দ দেয়। আমি বারবার আমার ছাত্রদের কাছে হেরে যেতে চাই। আমি মনে করি, ছাত্রের কাছে হেরে যেতে পারাটাই জিতে যাওয়া।
আরো পড়ুনঃ বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় জাবি শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন