আসুন, দেশপ্রেমের সজ্ঞা বদলে দেওয়া দুই বাংলাদেশী জিনিয়াস বাবা-ছেলের গল্প শুনি..

২ বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ট শিক্ষার্থী নির্বাচিত হওয়া এবং বিজ্ঞান প্রকল্পে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাত থেকে পদক নেয়া ডঃ মাহবুব মজুমদারের সবচেয়ে বড় পরিচয় প্রতিবছর বিশ্বসভায় বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনা গনিত অলিম্পিয়াড দলের কোচ!

অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ডঃ মাহবুব বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি থেকে স্নাতক,স্টানফোর্ড থেকে স্নাতকোত্তর,ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ থেকে পিএচডি এবং লন্ডন ইম্পেরিয়াল থেকে পোস্ট ডক্টরাল করেন।

কিন্তু অন্য দশজনের মতো তিনি বিদেশে নিজেকে প্রতিষ্টিত না করে দেশের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করার স্বপ্নে ফিরে আসেন দেশের মাটিতে!

বিদেশের বিলাসী জীবন ও কোটি টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরার পর ডঃ মাহবু্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেন।কিন্তু কি এক বিচিত্র-অদ্ভুত কারনে উঁনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ দেয়া হয়নি!

এরপর নিজ উদ্যোগেই গনিত উৎসব ও আন্তর্জাতিক গনিত অলিম্পিয়াডের জন্য বাংলাদেশ দল গঠনের প্রতি সদ্যপ্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডঃ জামিলুর রেজা চৌধুরীর সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন!

এরকিছু দিন পরেই সৌদি সরকারের কাছ থেকে ডঃ মাহবুবের কাছে চিঠি আসে সৌদি আরবের গনিত অলিম্পিয়াড দলকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ওরা মাহবু্বকে চায়! ডঃ মাহবু্ব তাদের চিঠির উত্তরে বলেছিলেন” আমি বাংলাদেশেই থাকব”!

তারপর পুরোদমে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেরা তরুণ প্রতিভা নির্বাচিত করার কাজে!

পরবর্তীতে দেশসেরা তরুণ গনিতবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করে নেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য!

এরপরের বাকিটা শুধু ইতিহাস! আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের পর মাত্র কয়েক বছর যেতে না যেতেই বাংলাদেশ দল তাদের ঝুঁড়িতে অনারেবল মেনশন, ব্রোঞ্জ ও রোপ্য পদক জয় করে সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে জানান দেয় ” সুযোগ আর পরিচর্যা পেলে তারাও বিশ্বজয় করতে পারে”!

২০১৮ সালে রোমানিয়ায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিয়াডে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীর হাত ধরে বহুবছরের অধরাই থাকা একমাত্র গোল্ড মেডেলও পেয়ে যায় বাংলাদেশ!

সর্বশেষ গত সপ্তাহে রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলের ছয়জনের মধ্যে সবাই জয়লাভ করে রোপ্যসহ ব্রোঞ্জ পদক!

সেইসাথে তালিকায় বাংলাদেশ উঠে আসে দক্ষিন এশিয়ার শীর্ষস্থানে!

প্রতিবছর মাহবুব মজুমদারের হাত ধরেই তৈরি হওয়া পদকজয়ী সব ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে ভর্তি করানোর জন্য কাড়াকাড়ি দেয় বিশ্বসেরা এমআইটি, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়! বিশ্বের শ্রেষ্ট বিদ্যাপীঠগুলোতে ছড়িয়ে আছে মাহবুব মজুমদারের ছাত্ররা!

যে হাতে তিঁনি বিশ্বসেরা জিনিয়াসদের তৈরি করছেন অক্লান্ত পরিশ্রম আর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সে কাজের জন্য তিনি শত অনুরোধ সত্বেও এক পয়সাও সম্মানী নেন না! এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন গনিত অলিম্পিয়াড টিমকে!

বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এমন উদ্যোগের কারণ হিসেবে ডঃ মাহবুব একবার এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন “আমার সবসময়ই ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে যাব,দেশের জন্য কাজ করব।

আমাদের দেশের তরুনদের মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই,এদের অসামান্য প্রতিভা আছে, সুযোগ পেলে তারা এদেশকে বিশ্বসভায় প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে”!

আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও উন্নতমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে গড়ার স্বপ্ন দেখেন ডঃ মাহবুব মজুমদার!

ডঃ বদিউল আলম মজুমদার

ডঃ বদিউল আলম মজুমদার

এদেশে হাতেগোনা যে কয়জন ব্যক্তি এ জাতির সমস্যা, সমাধান,সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা ও কাজ করছেন তাদের তালিকায় সম্ভবত সামনের সারিতেই উচ্চারিত হবে নিপাট ভদ্রলোক ডঃ বদিউল আলম মজুমদারের নাম!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ছয়দফা আন্দোলন,৬৯ গনঅভ্যুত্থানের মতো বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনে রাজপথে সামনের কাতারেই ছিলেন সবসময়।

পরবর্তীতে মার্কিন সরকারের বৃত্তি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ল্যারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেলোশিপ গ্রাজুয়েশন এবং ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে পিএচডি ডিগ্রি অর্জন করেন!

দীর্ঘ ১৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সিয়াটোল,ওয়াশিংটন স্টেট,সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ে!

বিদেশে থেকেও মাতৃভূমিকে তিনি ভুলে যান নি।মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত আদায়ের জন্য দিনরাত ঘুরে বেড়িয়েছেন নিউইয়র্কের প্রতিটি অলিগলিতে।

বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন।

বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা “নাসার”কনসালটেন্ট হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন অনেকদিন!

নিযুক্ত ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের পরামর্শক হিসেবেও!

১৯৯১ সালে ছুটি নিয়ে দেশে বেড়াতে আসেন।ছুটিতে এসে সিদ্ধান্ত নেন দেশে থেকে যাবেন।

কারন হিসেবে তিনি বলেছিলেন ” মার্ক টোয়েনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে,সেটি হল “মানুষের জীবনে দুটি দিন গুরুত্বপূর্ণ -যেদিন তার জন্ম হয় এবং যেদিন সে অনুধাবন করতে পারে কেনো তার জন্ম হয়েছে”।

আমি অনুধাবন করি বিদেশের এতো বর্ণাঢ্যময় কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করে দেশের জন্য আমার কিছু করার আছে! তারপর থেকে আর বিদেশে পাড়ি জমাননি!

দেশে যুক্ত হন দি হাঙ্গার প্রজেক্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে!

দেশে গনতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্টা করেন সিভিল সোসাইটি ” সুশাসনের জন্য নাগরিক “(সুজন)।

যেটি প্রতিষ্টার পর থেকেই দেশের সমস্যা,সমাধান ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।

দেশের অন্যসব সিভিল সোসাইটি যেখানে ক্ষমতা আর অর্থের কাছে নিজেদেরকে বিক্রি করে দিয়েছে সেখানে ডঃ বদিউল আলম মজুমদার স্রোতের বিপরীতে একাই হেঁটে চলেছেন একটি সভ্য ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্টায়!

একজন সনামধন্য কলাম লেখক হিসেবেও ডঃ মজুমদারের রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি!

আমেরিকান ইকোনোমিক্স এসোসিয়েশন, কানাডিয়ান ইকোনোমিক্সসহ বহু প্রফেশনাল অধিবেশনে তিনি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন!

বিশ্বের সব খ্যাতনামা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তার গবেষণা প্রবন্ধ!

জাতীয় ও নাগরিক স্বার্থে যখনই কোন আঘাত লেগেছে তখনই সবার আগে রাজপথে নেমে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন!

দেশ ও মানুষের কথা বলার কারণে ডঃ মজুমদার সবসময়ই স্বীকার হয়েছেন বিদেশি অপশক্তি ও সরকারের কাছ থেকে নানা হেনস্তা ও বাধা বিপত্তির!

কিন্তু দেশবিদেশের সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই ৭৪ বছর বয়সেও সমাজের প্রয়োজনে তিঁনি ছুটে চলেছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে!

ছেলে ডঃ মাহবুবকে বিদেশে কোটি টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরিয়ে আনার পেছনে বাবা ডঃ মজুমদারই রেখেছিলেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা!

এদেশের আনাচে কানাচে এমন গুটিকয়েক মানুষের জন্যই আমরা এখনো ঘুনেধরা দেশটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি একটি সভ্য,সুন্দর ও নিরাপদ বাংলাদেশের!

যারা সকাল বিকাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দেশপ্রেম বলে গলা ফাঁটিয়ে এ দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে এবং যারা ভুলতে বসেছে দেশপ্রেমের সজ্ঞা তাদের যেনো এই দুই বাবা-ছেলের গল্পই শুনানো হয়।

লেখাঃ আবরার আহমেদ